preloader
বাংলা বইয়ের e-ভুবন
Menu Categories Search Cart 0
Menu
Cart

Total 0 Items

☹ Your cart is empty

Sub Total:

$0

₹0

বিভাগ
চৈতন্যে বধিবে কে!: পর্ব ২০
ধারাবাহিক

চৈতন্যে বধিবে কে!: পর্ব ২০

...আবার ছারপোকা। এবার পায়ে। উঠে বসে স্বপ্ননীল। চেয়ারে বসে এখনও নাক ডাকছেন এস.আই মহাদেব। চাদর মুড়ি দিয়ে খানিক ঝিমোনোর পর হঠাৎ করে একটা অদ্ভুত জিনিস মনে হয় নীলের। স্যার যে নিউক্লিওটাইড এর কথা বলেছিলেন সেইগুলি আসলে কী? অ্যাডেনিন, গুয়ানিন, সাইটোসিন এবং থাইমিন। এ-জি-সি-টি। আচ্ছা… স্যারের যে ডাইরিটা দারোগা সাহেব ওকে দেখিয়েছিলেন, সেখানে কী লেখা ছিল? একবারে শেষের লাইন দুটো? মনে করার চেষ্টা করে। দু-এক মুহূর্তের মধ্যে মনে পড়ে যায়, অচ্যুত-গদাধর- চিকনকালা-ত্রৈলোক্যনাথ-কবে শেষ কথা / তাই এ আমার শেষের কবিতা...
শব্দগুলো থেকে কী পাওয়া যাচ্ছে? না, এ-জি-সি-টি ! বিছানা ছেড়ে লাফ দিয়ে ওঠে স্বপ্ননীল।
বিশ্বামিত্র সেনের ঘর থেকে এক নীল ডাইরি উদ্ধার করেছিল পুলিশ, যাতে অদ্ভুত কিছু বাক্য লেখা। সেই বাক্যগুলির অর্থ কি উদ্ধার করতে পারবে স্বপ্ননীল। দেখাই যাক…

চুয়ান্ন

ফুলওয়ারিতোড়। ঝাড়খণ্ড। দুই চৈতন্য কথা । আদি ও অনাদি।

গবাক্ষপথে বহুদূর অব্দি দেখা যায়। এমনকি সেই দুগ্ধা পাহাড় পর্যন্ত। ঘরে এতক্ষণ বেশ তীব্র আলো জ্বলছিল। দু’জনের মধ্যে আলোচনা চলছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে। সবথেকে কম ঝুঁকি নিয়ে কী করে শেষ করে দেওয়া যায় অনাদি গোসাঁইকে।

যতই পূর্ব প্রস্তুতি থাক না কেন, শেষ মুহূর্তে কোন পথে এবং কী ভাবে আক্রমণ শানানো হবে সেই সম্পর্কে একটা চূড়ান্ত পরিকল্পনা করে নিতেই হয়। যে কোনও অ্যাকশন স্পটে যাওয়ার আগে এই হোমওয়ার্কটুকু জরুরি।

যাই হোক, নিজেদের মধ্যে কথা শেষ হলে ঘরের জোরালো আলোটা নিভিয়ে দিয়ে একটা মৃদু আলো জ্বালায় অনন্ত মহাষুর। তারপর ধীর পায়ে জানলায় গিয়ে দাঁড়ায়। পিছনে আসেন অরবিন্দ প্রতিহারী।

দুগ্ধার মাথায় রাধামাধব মন্দিরের আলোকিত চূড়াটা নজরে পড়ছে এইখান থেকে। শুনশান হয়ে আসা এই শিল্পনগরীর বুকে গভীর নিশুতি নেমে আসছে ক্রমে। দেবালয় শীর্ষে যে পতাকা, তা উড্ডীয়মান দামোদর ছোঁওয়া বাতাসে। যেন অনাদি গোঁসাই, বহুদূর থেকে তাঁর সাধের চাঁদপুরার শরীরে জড়িয়ে দিচ্ছেন শান্তি আর প্রেমের জয়ধ্বজা।

“এইখান থেকে কতটা পথ হতে পারে বলে মনে হয়?”
“চাষের জমি ভেঙে গেলে মাইল দু'য়েকের বেশি হবে না।”
অনন্ত মহাষুরের প্রশ্নের উত্তরে বললেন অরবিন্দ প্রতিহারী।
“তাহলে গাড়ি না নিয়ে হেঁটে যাওয়াই শ্রেয়।”
“হ্যাঁ আমিও সেটাই ভেবেছি। এই ধরনের অ্যাকশনে লটবহর যত কম থাকে ততই ভালো।”

দুই মৃত্যুর কারবারির চোখে যেন অসহ্য, দুগ্ধার মাথায় ওড়া অনাদির ওই ‘জয়-পতাকা’। তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে বাতাসে ভাসিয়ে না দেওয়া অব্দি রাত্রি তাদের কাছে নিদ্রাহীন।

গুণ্ডিচা বাড়ি অতিক্রম করিয়া আরও বেশ খানিক অগ্রসর হইলে পৌঁছানো যায় সেই স্থানে, যেথায় মিলিত হইয়াছেন রায় রামানন্দ, মহাকাল প্রতিহারী এবং জগন্নাথ দাস।

কুচক্রী জগন্নাথ প্রভুর প্রাণ সংশয়ের কথা উত্থাপন করিয়াছেন, কিন্তু সে সম্ভাবনার কথা রামানন্দের নিকটে আকস্মিক নহে। কাজেই তিনি চমকিত না হইয়া জগন্নাথকে স্থির কণ্ঠে প্রশ্ন করিলেন, “আপনাদিগের এই রূপ আশঙ্কা হইবার কারণ?”

পঞ্চসখা প্রধান জগন্নাথদাস কালবিলম্ব না করিয়া উত্তর করিলেন, “নেপথ্যে থাকিয়া কোনও এক শক্তি প্রভুর প্রাণ নাশ করিতে চায় বলিয়া বোধ হইতেছে । কিছুকাল পূর্বে গম্ভীরায় যে ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহা সম্পর্কে আমরা সবাই সম্যক অবগত আছি।”

“গম্ভীরায় তো কিছু সেইরকম কিছু ঘটিয়াছে বলিয়া স্মরণ করিতে পারিতেছি না।”

“কী বলিতেছেন ভদ্র! কিছুই কি ঘটে নাই। নাকি জানিয়া বুঝিয়া আমাদিগের নিকট অস্বীকার করিতেছেন! গম্ভীরায় দ্বার ভিতর হইতে বন্ধ রহিল। অথচ প্রভুকে অচেতন অবস্থায় আবিষ্কার করা হইল জগন্নাথ মন্দিরের গুপ্তপথের সম্মুখে ! ইহা কি স্বাভাবিক বিষয় বলিয়া বোধ হয় আপনার?”

রামানন্দ কোনোরূপ উত্তর না করিয়া চুপ করিয়া রহিলেন।

জগন্নাথদাস চারিদিক একবার পরিলক্ষণপূর্বক কণ্ঠস্বর খানিক নামাইয়া কহিলেন, আমাদিগের তো প্রভুর দেহরক্ষী কাশীশ্বর এবং ভৃত্য গোবিন্দকে যারপরনাই সন্দেহ হইতেছে। আমাদের বিশ্বাস ইহারাই প্রভুর খাদ্যে বিষ মিশাইয়াছে এবং শুধু তাহাই নহে, প্রভু অচেতন হইয়া পড়িলে ইহারাই প্রভুকে বাহিরে আনিয়াছে, এবং একজন ফিরিয়া গিয়া অন্দর হইতে কবাট বন্ধ করিয়াছে। যাহাতে ভক্তগণের নিকটে ইহাও, প্রভুর এক লীলা বলিয়া প্রচার করিতে পারে। যাহাতে... ইহা বলিতে সক্ষম হয় যে, প্রভু দ্বার রুদ্ধ থাকা স্বত্বেও আপন লীলার উপর ভর করিয়া বাহির হইয়া গিয়াছেন। এবং কর্পূরের মত উবিয়া গিয়াছেন। প্রভুর প্রাণ বাহির হইয়া গেলে প্রভুর নশ্বর দেহটি সরাইয়া ফেলিতে উহাদের আর কতক্ষণ লাগিত ! খুব সম্ভব মন্দিরের গুপ্তপথেই তাহারা প্রভুকে, সরাইয়া লইয়া যাইবার মতলবে ছিল। জীবিত অথবা মৃত।

রায় রামানন্দ দীর্ঘকাল ধরিয়া মহারাজা প্রতাপরুদ্রের প্রশাসনিক বিভাগে বহাল ছিলেন। আর শুধু তাহাই নহে অত্যন্ত দক্ষতার সহিত সেই দায়বদ্ধতা পালন করিয়াছেন। কাজেই ইহা ভাবিয়া লইবার কোনও অবকাশ নাহি যে তিনি কূটনীতি কাহারও অপেক্ষা কম বুঝেন। রামানন্দ কিঞ্চিৎ সময় লইয়া প্রশ্ন করিলেন, “যাহা বলিতেছেন তাহা আমি অবশ্যই জ্ঞাত কিন্তু একখানি প্রশ্ন আমার আছে।”

“নিবেদন করুন ।”
“প্রভুকে জীবিত অথবা মৃত, জগন্নাথ মন্দিরের গুপ্তপথ দিয়া সরাইয়া লইয়া যাওয়াই যদি তাহাদিগের উদ্দেশ্য হইয়া থাকে, তাহা হইলে কুচক্রীগণ তাহা না করিয়া প্রভুকে ঐ স্থানে ফেলিয়া প্রস্থান করিল কেন?”
“ইচ্ছা করিলেই কারণ বুঝিতে পারা যায়। নিশ্চয়ই উহারা অন্তিম সময়ে এইরূপ কোনও সমস্যার সম্মুখীন হইয়াছিল, যাহাতে তাঁহাদের সম্যক উপলব্ধি হয় যে, সে যাত্রা তাহাদের সফল হওয়া সম্ভব তো নহেই, বরঞ্চ তাঁহাদের রূপ জনসমক্ষে প্রকাশ হইয়া পড়িতে পারে। কাজেই দিগবিদিক না পাহিয়া প্রভুকে ঐ অবস্থায় ফেলিয়া চম্পট দিয়াছে।”
প্রাক-সন্ধ্যায়, সাগরতটে বাতাস বেশ তীব্র হইয়া উঠিয়াছে। উড়ন্ত বালুকারাশি রামানন্দের উত্তরীয় মলিন করিতে যেন উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছিল। রামানন্দ সেইদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করিয়া আরও একখানি প্রশ্ন করিলেন, “গোবিন্দ এবং কাশীশ্বরকে আপনাদিগের সন্দেহের হেতু?”

কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’

পঞ্চান্ন

চন্দ্রপুরা থানা। ঝাড়খণ্ড।

চোখ ঘুমে জুড়িয়ে আসছিল কিন্তু বিছানায় গা দেবার পর আর কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না স্বপ্ননীলের। বিশ্বামিত্র বাবুর মুখটা মনে পড়ছে বারবার। একটা সত্যিকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন মানুষটা। প্রায় পৌঁছেও গিয়েছিলেন ঈপ্সিত লক্ষ্যে। সেইজন্যই কি খুন হয়ে যেতে হল তাকে?

এখনও মনে আছে, নবদ্বীপের বাড়ি থেকে বিদায় নেবার আগে গ্রান্ডফাদারকে একটা অদ্ভুত কথা বলেছিলেন বিশ্বামিত্র, “আচ্ছা রত্নাকর বাবু আপনার বাড়িতে এমন কিছু আছে, যা আপনারা বংশপরম্পরায় ব্যবহার করে আসছেন ?”

“কেন বলুন তো!”
“না, আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে, মহাপ্রভুর তো কোনও সন্তান ছিল না। এদিকে,আপনারা হচ্ছেন বিশ্বরূপ মিশ্রর ‘সরাসরি বংশধর’। মানে আমি সেইরকমই ভাবছি। আপনাদের থেকে ডিএনএ এক্সট্রাকশন করা হল ঠিকই, কিন্তু সেটার সাথে মহাপ্রভুর ‘ম্যাচিং পার্সেন্টেজ’ একটু হলেও কমে যাবে। যে আপনাদের ‘সরাসরি’ পূর্বপুরুষ তাঁর থেকে যদি ডিএনএ এক্সট্রাকশন করতে পারতাম, তাহলে আমার কাজের ক্ষেত্রে আরও সুবিধা হত।”

রত্নাকরও, বিশ্বামিত্রের সত্যানুসন্ধানের চেষ্টায় এক সময় বেশ উৎসাহিত হয়ে পড়েছিলেন। অন্তত, বাইরে থেকে দেখে তাই মনে হচ্ছিল। এই কথায় খানিক নিরাশ হন। বলেন, “না নেই। তাহলে!”

রত্নাকরের কথা শেষ হবার আগেই বিশ্বামিত্র বলেন, “না নিরাশ হবার কিছু হয়নি। একটু ভেবে দেখুন যে তাঁর ব্যবহৃত কোনও সামগ্রী সংরক্ষিত আছে কিনা? অনেক পরিবারেই অনেক সময় এই রকম বস্তুর সংরক্ষণ করা হয়। দেখুন যদি থেকে থাকে তবে সেটা থেকেও খুব গুরুত্বপূর্ণ স্যাম্পল পাওয়া যেতে পারে...।”

রত্নাকর বাবু দু-এক মুহূর্ত চিন্তা করেন, তারপর উঠে দাঁড়ান, “আসুন আমার সাথে....”

বাইরে তখনও বৃষ্টি। ধুলো ভেজা একটা মিষ্টি গন্ধ বাতাসে। সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে শুরু করেন রত্নাকর। পিছন পিছন বিশ্বামিত্র। স্বপ্ননীলের ভিতরেও একটা উত্তেজনা। সেও পিছু নেয়।

তলায় টানা বারান্দার শেষে একটা ঘর। বাইরে থেকে দেখে কোনও বিশেষত্ব আছে বলে মনে হয় না। বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রত্নাকর হাঁক দেন আসুকে। চাবি নিয়ে আসতে বলেন। এক মিনিটও সময় লাগে না আসুদার। ভিতরে ঢুকে আলো জ্বালান রত্নাকর।

বিরাট ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় একটা পালঙ্ক। চারদিকে চোখ ঘোরান বিশ্বামিত্র সেন। দেয়ালে দুটো অয়েল পেইন্টিং। একজন মহাপ্রভু কিন্তু আর একজন কে? এবং সেই অজানা ব্যক্তির ছবি খুব অল্প বয়েসের।”

রত্নাকরের গলা শোনা যায়, “মহাপ্রভুর পাশের জনই হলেন বিশ্বরূপ। আপনার কথা অনুযায়ী আমাদের ‘সরাসরি পূর্বপুরুষ’।”

বিশ্বরূপের ছবি সেভাবে দেখাই যায় না। মহাপ্রভুর একটা পারিবারিক স্কেচ অনেক কষ্টে যোগাড় করেছিলেন বিশ্বামিত্র। সেইখানে বিশ্বরূপের যে ছবি ছিল তার সাথে এই চিত্রের কোনও মিল নেই। তাই চিনতে পারেননি।

পেইন্টিং এর পাশে একটা সিন্দুক। রত্নাকর বাবু এগিয়ে যান ওইদিকে। উপরের চাকতিটা কায়দা করে দু’দিকে ঘোরান। সংখ্যার পারমুটেশন কম্বিনেশন। খুলে যায় সিন্দুক। লাল কাপড়ে মোড়া, লম্বা মত একটা জিনিস বার করেন। মি. সেনকে ডাকেন চোখের ইঙ্গিতে।

আবরণ উন্মোচিত হলে ঐ বস্তু চিনতে পারা যায়। চিরুনি জাতীয় কিছু। যা ঠিক আধুনিক চিরুনির মত নয়।

“এটা কার?”
বিশ্বামিত্রের গলার স্বরে মুগ্ধতা।
“আমার পিতামহ এই সিন্দুকটি বানিয়েছিলেন। পিতা সন্ধ্যাকরের মুখে শুনেছি, বিশ্বরূপ মিশ্রের ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তিনি ওইটি তৈরি করেন। তাহলে এটা কি ধরে নেওয়া যায় না যে, এই চিরুনিটি মাননীয় বিশ্বরূপ মিশ্রের। তবে কোথা থেকে এইসব সামগ্রী তিনি উদ্ধার করেছিলেন তা আমি ঠিক জানি না।”
“ইউরেকা...”
লাফিয়ে ওঠেন বিশ্বামিত্র। বলেন, “যদি কিছু মনে না করেন আপনাকে একটা অনুরোধ করতে পারি…”
“বলুন...”
“আমি কি এই চিরুনিটি নিয়ে যেতে পারি? কিছু ভাববেন না, আমার কাছে এটি সযত্নে রক্ষিত থাকবে। হারাবার কিংবা চুরি যাবার ভয় নেই।”
রত্নাকর বাবু কিছু না বলে চুপ করে থাকেন। মিস্টার সেন আবার বলেন,
“কাজ হয়ে গেলে ফিরিয়ে দেব আপনাকে। অ্যাকচুইয়ালি এটার থেকে কোনও স্যাম্পেল কালেক্ট করতে পারলে, সেইটাকে ‘বেস’ ধরে নিয়ে দু-দিকের সাথেই মেলাতে পারব। আই মিন...এটার সাথে আপনাদেরটা এবং মহাপ্রভুরটা, দুটো স্যাম্পেলই কম্পেয়ার করা যাবে। দুই ক্ষেত্রে রেজাল্ট একই আসলে বোঝা যাবে আপনারা মহাপ্রভুরই বংশধর। পরীক্ষা লব্ধ ফলাফল হবে অনস্বীকার্য।”

ছাপ্পান্ন

চন্দ্রপুরা থানা । ঝাড়খণ্ড।

থানার ক্যাম্পখাট। ছারপোকা না থেকে যায় না। একটা কষিয়ে কামড় দেয় ঘাড় আর মুন্ডুর সংযোগস্থলে। যে চটকাটা এসেছিল ভেঙে যায় স্বপ্ননীলের। উঠে বসে। জলতেষ্টা পেয়েছে খুব।

মহাদেব নিজের চেয়ারে বসে ঝিমোচ্ছেন। ভালোই নাইট ডিউটি করছেন এস.আই! খোলা জানালা দিয়ে থানার গেট অব্ধি দেখা যায়। কে যেন দাঁড়িয়ে আছে না গেটের সামনে! কৃষ্ণচূড়া গাছের বিরাট এক ডাল এসে ঝাপটাচ্ছে ওইখানে। তার মধ্যে কুয়াশার হালকা চাদর বাঁধা সৃষ্টি করেছে দৃষ্টিপথে। কে ওখানে ঠিক বোঝা যায় না। দ্বিগু সরেন বলে লোকটা হতে পারে, আবার অন্য কেউও হতে পারে।

কোথাও কোনও আওয়াজ নেই। একমাত্র, ভারি যান চলাচলের একটা আওয়াজ ভেসে আসছে হাইওয়ে থেকে। গভীর রাত। আচ্ছা... থানাতে কি আদৌ নিরাপদ স্বপ্ননীল? গোটা দুয়েক বাইক হানা দিলেই তো যথেষ্ট। হাজিরা কনস্টেবল আর দ্বিগুকে কুপোকাত করা শুধু সময়ের অপেক্ষা। তারপর, জানলা দিয়ে ইস্পাতের নলটা ঢুকিয়ে ...। ব্যাস, ক্যাম্পখাট হয়ে যাবে খাটিয়া। এগিয়ে গিয়ে জানালাটা বন্ধ করে দেয় নীল। আবার এসে শুয়ে পড়ে।

ফেব্রুয়ারি মাস। জানুয়ারি চলে গেলেই কলকাতায় শীতের খোলসটা পড়ে থাকে শুধু। কিন্তু এখানে বেশ ঠাণ্ডা। স্টেশনে নেমেই বাতাসে শীতের টান অনুভব করা গিয়েছিল। পরে নানাবিধ উত্তেজনায় অতটা মালুম হয়নি। কিন্তু এখন শরীরে বেশ কাঁপুনি।

ছারপোকা এবং শীত, শুয়ে থাকাই দায়। মনে পড়ে, একটা পাতলা চাদর এনেছে সাথে। বিছানার কাছেই ছিল ব্যাগটা। উঠে বার করে। আগাপাছতলা মুড়ি দিয়ে শোয়। চাদরের তলায় নিরাপত্তা খোঁজে স্বপ্ননীল। সে কি আদৌ দারোগা সাহেবকে দিতে পারবে বিশ্বামিত্র হত্যার ক্লু? আজ রাতে তার এলোমেলো চিন্তার জট থেকেই বেরিয়ে আসবে না তো কোনও সূত্র? দেখাই যাক।

আগের বার স্বপ্ননীল এসেছিল বিশ্বামিত্রের অতিথি হয়ে। মিস্টার সেনকে কী বলে ডাকা যায় বুঝতে না পেরে শেষমেশ ‘স্যার’ বলেই ডাকত সে। এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানো, আর স্যারের সাথে ল্যাবরেটরিতে এঁটুলির মত লেগে থাকা, দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছিল কয়েকটা দিন।

বিশ্বামিত্রবাবু নীলকে হাতে ধরে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ডিএনএ টেস্টের খুঁটিনাটি। ফার্মাকোলজির স্টুডেন্ট। বিষয়গুলো একেবারে অজানা ছিল না, তাও, চুপ করে শুনেছিল স্বপনীল। প্রথমে একটা ছোটো মত মেশিন দেখিয়ে বলেছিলেন, “এটা হল পলিমার চেইন রিক্যাশন বা পি সি আর মেশিন। এটার মধ্যেই ঘটবে ডিএনএ রেপ্লিকেশন।”

“কী ভাবে?”
নীলের এই জিজ্ঞাসার পর উঠে গিয়ে একটা বড় কাগজ, আর লাল-নীল-স্কেচ পেন নিয়ে এসেছিলেন বিশ্বামিত্র, “প্রথমে আমি তোমায় ডিএনএ টেস্টের স্টেপগুলো বলি। তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে। স্যাম্পেল কালেকশন-স্যাম্পেল পিউরিফিকেশন-ফ্রাগমেন্টেশন অ্যান্ড দেইন, ডি এন এ সেপারেশন...”
“তারপর ?”
উনি যাই বলুন না কেন। থামলেই মনে হয় ছন্দ পতন। উস্কে দিয়েছিল নীল।
“দেইইন… টার্গেট ডিএনএ, তার থেকে আবার মাল্টিপল টার্গেট ডিএনএ। আর এটাই ঘটে পিসি আর মেশিনের ভিতর।”

এতটা বলার পর হাতের কাগজটা টেবিলের উপর রেখে, লাল, নীল এবং সবুজ কালি দিয়ে তিনটে বৃত্ত আঁকেন বিশ্বামিত্র। সবগুলি বৃত্তের মধ্যে আবার কতগুলি বিন্দু। এক-দুই-তিন করে তিনটি বৃত্তের নাম্বারিং করেন। ফের বলতে শুরু করেন, “প্রথম বৃত্তের বিন্দুগুলিকে ধরে নিলাম প্রাইমার, দ্বিতীয়টার বিন্দুগুলিকে ধরলাম পলিমারেজ বা এনজাইম আর তৃতীয়টার বিন্দুকে মনে করলাম নিউক্লিওটাইড। নিউক্লিওটাইড অর্থাৎ অ্যাডেনিন-সাইটোসিন-গুয়ানিন অ্যান্ড থাইমিন। যাই হোক... এরপর সবগুলিকে, অর্থাৎ, প্রাইমার-পলিমারেজ- নিউক্লিওটাইড একসাথে টেস্ট কিটে নেব, এছাড়াও নিতে হবে কিছু অসম্পূর্ণ ডিএনএ। দেইইন সেগুলি ‘প্লেস’ করতে হবে মেশিনে, ব্যাস এবার যা করার ওই যন্ত্রই করবে।”

“কী ভাবে?”
মি. সেন বলে চলেন। যার সবটা নীল বুঝতে না পারলেও অনেকটাই বুঝতে পারে, “প্রথমে,একটা নির্দিষ্ট টেম্পারেচারে হবে ডিন্যাচারেশন...”
এই শব্দটা নীলের খুব পরিচিত নয়। হাঁ’টা আরও একটু বড় হয় তার। আরও ডিটেলিং শুরু হয়, “মানে, যে ডিএনএ গুলো দেওয়া হয়েছে সেগুলো, ওই টেম্পারেচারে ভেঙে যাবে। তারপর যে প্রাইমার দেওয়া হয়েছে তারা শুরু করবে অ্যানিলিং। মানে বিক্রিয়া। এরপর আসবে পলিমারেজ বা এনজাইম।
“এনজাইম... মানে যাকে বলা হয় জৈব অনুঘটক?”
“ইয়েস...একদম ঠিক। তা, এরা যে যার মত গিয়ে যুক্ত হয়ে যাবে নির্দিষ্ট ডিএনএর সাথে। এই ‘যুক্ত হওয়া’ ব্যাপারটা কিন্তু পি সি আর মেশিনও করছে না, এই বিষয়টা প্রি-ডিটারমাইন্ড। তাহলে কী হল , না ডিএনএ ভেঙে গেল তারপর এনজাইমগুলো যে যার মত যুক্ত হয়ে গেল ওই ভেঙে যাওয়া ডিএনএ-র সাথে...”
“মেশিন করছে না ! তাহলে কে করছে? ভারি অদ্ভুত তো!”
“হ্যাঁ অদ্ভুত। বলা যেতে পারে, এটা করছে ডিএনএ স্বয়ং। এরপরে আরও কাজ বাকি থাকে যা আরও চমকপ্রদ।”
“কী !”
“যে নিউক্লিওটাইডগুলো, মানে অ্যাডেনিন-সাইটোসিন-গুয়ানিন অ্যান্ড থাইমিন দেওয়া হয়েছিল, তারাও গিয়ে স্পেসিফিক প্রাইমার, এনজাইম এবং ভাঙা ডিএনএ-র সাথে যুক্ত হবে এবং তৈরি করবে এক একটা নতুন এবং সম্পূর্ণ ডিএনএ। এই ভাবেই চলতে থাকবে ডিএনএ রেপ্লিকেশন। অল্প সময়ের মধ্যে তৈরি হবে, একটি টার্গেট ডিএনএ থেকে লক্ষ লক্ষ টার্গেট ডিএনএ। যার ফলে পরীক্ষা হয়ে উঠবে অনেক সহজ...।”

আবার ছারপোকা। এবার পায়ে। উঠে বসে স্বপ্ননীল। চেয়ারে বসে এখনও নাক ডাকছেন এস আই মহাদেব। চাদর মুড়ি দিয়ে খানিক ঝিমোনোর পর হঠাৎ করে একটা অদ্ভুত জিনিস মনে হয় নীলের। স্যার যে নিউক্লিওটাইড এর কথা বলেছিলেন সেইগুলি আসলে কী? অ্যাডেনিন, গুয়ানিন, সাইটোসিন এবং থাইমিন। এ-জি-সি-টি। আচ্ছা… স্যারের যে ডাইরিটা দারোগা সাহেব ওকে দেখিয়েছিলেন, সেখানে কী লেখা ছিল ? একবারে শেষের লাইন দুটো? মনে করার চেষ্টা করে। দু-এক মুহূর্তের মধ্যে মনে পড়ে যায়,

“অচ্যুত-গদাধর- চিকনকালা-ত্রৈলোক্যনাথ-কবে শেষ কথা / তাই এ আমার শেষের কবিতা…”
শব্দগুলো থেকে কী পাওয়া যাচ্ছে? না, এ-জি-সি-টি! বিছানা ছেড়ে লাফ দিয়ে ওঠে স্বপ্ননীল।


কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন


এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।

মন্তব্য করুন

লেখক

জন্ম-৮ সেপ্টেম্বর, কলকাতা। ছাত্রাবস্থায় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার মাধ্যমে লেখালেখির শুরু। এই উপন্যাস ছাড়াও লেখকের প্রকাশিত অন্য উপন্যাসগুলি হল— ‘আসলে ভালবাসার গল্প’, ‘রোধবতীর নীল রং’, ‘একে রহস্য দুইয়ে লক্ষ্যভেদ’। দেশ, আনন্দমেলা, কৃত্তিবাস, কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান, কথা-সাহিত্য, বহুরূপী এবং আনন্দবাজার পত্রিকায় ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু লেখা। এছাড়াও বাংলার শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের সম্মান ‘সুন্দরম পুরস্কার’ পান ২০১৪ সালে।

অন্যান্য লেখা

দেখতে পারেন