preloader
বাংলা বইয়ের e-ভুবন
Menu Categories Search Cart 0
Menu
Cart

Total 0 Items

☹ Your cart is empty

Sub Total:

$0

₹0

বিভাগ
চৈতন্যে বধিবে কে!: পর্ব ১৯
ধারাবাহিক

চৈতন্যে বধিবে কে!: পর্ব ১৯

চন্দ্রপুরা প্ল্যাটফর্মে যখন ঢুকল স্বপ্ননীলের ট্রেন তখন রাত প্রায় নটা। গোটা কুড়ি লোকও বোধ হয় নামেনি। পুরো এলাকাটা যেন অন্ধকার বুকে মেখে দাঁড়িয়ে থাকা এক মৃত্যুপুরী।
হ্যাঁ, অবশেষে স্বপ্ননীল পৌঁছে গেল চন্দ্রপুরা। এইবার সে কীভাবে সরাসরি জড়িয়ে পড়ে বিশ্বামিত্র হত্যা রহস্যে সেটাই দেখার। ওর জন্যও এই চন্দ্রপুরার বুকে ভয়ংকর কোনও বিপদ অপেক্ষা করে নেই তো? দেখাই যাক…

বাহান্ন

চন্দ্রপুরা স্টেশন। ঝাড়খন্ড।

প্ল্যাটফর্মের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা চলে গেছে, রেল লাইনের সমান্তরালে। দু-একটা হেডলাইটের আলো ছুটে যাচ্ছে এদিক ওদিক।

একটু চা খেতে পারলে ভালো হত। এদিক ওদিক ঘাড় ঘোরায় স্বপ্ননীল। ওই পাড়ে একটা ছোটো দোকান, ওভারব্রিজের ঠিক পায়ের কাছে। আগেও এইখানে এসেছে সে। কাজেই, রাস্তাঘাট মোটামুটি চেনা। থানায় যেতে হলে এদিক দিয়ে বেরিয়েই অটো ধরতে হবে। কিন্তু এখন একটু ধোঁয়া ওঠা পানীয় না হলে, অবসন্ন দেহটাকে আর টানা যাচ্ছে না। উঠে পড়ে ওভারব্রিজে।

উপর থেকে স্টেশন চত্বরের বাইরেটা দেখা যায়। ফুলওয়ারিতোড়ের দিকটা পুরোপুরি অন্ধকার। নিকষ কালো যাকে বলে। আসলে ওপাশে এখন যা চোখে পড়ছে তার বেশিরভাগটা জুড়েই জঙ্গল। শুনশান নৈসর্গ জুড়ে বিষন্নতা। তারই মধ্যে একটা মালগাড়ির সাইডিংয়ে যাওয়ার বিকট আওয়াজ। ওই শব্দ মোটেই মানানসই নয় এই আবহে। যেন নিশুতির পেট ভোজালি দিয়ে চিরে দিচ্ছে কেউ। একটা বিরাট শিরিষগাছ ঝাপিয়ে এসে পড়েছে ওভারব্রিজের উপর। গা জোয়ারি এক অন্ধকারের অদ্ভুত নৈরাজ্য চারদিকে। হঠাৎ করে গা ছমছম করে ওঠে স্বপ্ননীলের।

চোখ সরিয়ে তাকায় ঝর্ণাডিহির দিকে। দূরে, ডি-ভি-সি’র চিমনিটা চোখে পড়ে। তালগাছের মত একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা দানবের শরীরে লাইটগুলো জ্বলছে নিভছে। আকাশ-প্রদীপ যেন।

ডি-ভি-সি থেকে মুখ ফিরিয়ে চায়ের দোকানের দিকে তাকায় নীল। এমন সময় হঠাৎ মনে হয়, ওর পিছনে কেউ একটা দাঁড়িয়ে! ডান দিক ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা।

স্বপ্ননীল ঘুরে তাকাতেই সিঁড়ি দিয়ে হুড় হুড় করে নামতে শুরু করে সেই রহস্য মানব! রেলওয়ে ওভারব্রিজ কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। যে কেউ যখন খুশি এসে দাঁড়াতেই পারে। কিন্তু দু-এক মুহূর্তের মধ্যে একটা অন্য কথা মাথায় আসে নীলের। সাথে সাথে কেমন যেন গুলিয়ে ওঠে সারাটা শরীর। ও যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে রেলিংয়ের উপর দিকটা নেই। ফাঁকা। পিছন থেকে একটা আলতো টোকা মারলেই সোজা পঞ্চাশফুট নীচে। নীল যদি সময়মত মাথাটা না ঘোরাত, তবে মুহূর্তে সব শেষ হয়ে যেতে পারত!

কিন্তু তাকে কেউ খুন করতে চাইবে কেন? সাথে সাথে মনে পড়ে, বিশ্বামিত্র বলেছিলেন, ও হচ্ছে একজন ‘রেফারেন্স’। আর শুধু রেফারেন্সই নয়, বিশ্বামিত্রর গবেষণার একজন সহযোগীও বটে। বিশ্বামিত্র খুন হয়েছেন এইবার নিশ্চয়ই ওর পালা। তা না হলে, ওই অন্ধকারে, ঠিক ওর পিছনে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে কেন অচেনা আগন্তুক!

নামতে নামতেই পিছন ঘুরে তাকায় একবার। না এখন কেউ নেই। এদিকে না এসে ওপাশ দিয়েই বা নামল কেন! নীলের সন্দেহ আরও বদ্ধমূল হয়। যে, ওপাড় থেকে এপাড়ে আসার জন্য ব্রিজে উঠেছে, কৌতূহলবশত নীলের পাশে দাঁড়াতেই পারে। কিন্তু তারপর তো এইদিক দিয়েই নেমে যাবার কথা তার। কখনই ওইদিকের প্ল্যাটফর্মে ফিরে যাবে না।

চায়ের নেশা মুহূর্তে ছুটে যায়। তিন লাফ দিয়ে আবার উঠে আসে ব্রিজের মাথায়। যে জায়গায় দাঁড়িয়েছিল, সেখানকার রেলিংটা আরও একবার দেখে। তলার দিকে মাত্র ফুট চারেক, লোহার জাল দিয়ে ঘেরা। কিন্তু উপরের রেলিংয়ের কিচ্ছু অবশিষ্ট নেই। মরনফাঁদ যাকে বলে।

প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়েই অটোস্ট্যান্ড। এটা কলকাতা অথবা শহরতলি নয়, যে সব সময় গাড়ি থাকবে। সওয়ারি কম। বাহনও কম। একখানা ডিজেল অটো দাঁড়িয়ে আছে মাত্র। স্টেশনের বাইরে বিরাট উঁচু এক বাতিস্তম্ভ আছে বটে, তবে তা নিষ্প্রভ। দোকান থেকে ছিটকে আসা আলোই ভরসা। অটো রিজার্ভ করে উঠে পড়ে স্বপ্ননীল। থানায় যেতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

ভাঙাচোরা রাস্তা। হলুদ ভেপার আলোয় ধুলোর ঝড়। খানিকটা এগিয়ে গেলেই একটা ছোট্টো বাজার। বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে এতক্ষণে। যেগুলি এখনও খোলা, তারা পসরা গোটাচ্ছে। ঘড়ির দিকে তাকায় নীল। মাত্র সাড়ে ন’টা কিন্তু এই অলীক শহরে এখন অনেক রাত।

অটো আরও একটু যেতে না যেতে হঠাৎ করে একটা ভয়ংকর শব্দ! সচকিত হয়ে নীল অটোওয়ালাকে শুধোয়, “ক্যায়া হুয়া!”

উত্তরে মাত্র দুটো শব্দ খরচ করে স্টিয়ারিংয়ে বসা ছেলেটি, “সাইলেন্সর পাইপ...”

প্রথমে কিছু বুঝতে না পারলেও, দু-এক মুহূর্তের মধ্যেই বোধগম্য হয়। সাইলেন্সর পাইপটা গেছে। মুখটা বার করে স্বপ্ননীল। ঝর্ণাডিহির কাছাকাছি চলে এসেছে। ওই তো দেখা যাচ্ছে ডি-ভি-সি’র চিমনি। এখান থেকে থানা বড়জোর মিনিট দশেকের হাঁটা পথ হবে। ভাড়া মিটিয়ে হাঁটতে শুরু করে। চিমনিটার ঠিক পায়ের কাছ থেকে একটা রাস্তা বেঁকে গেছে বাঁ দিকে। সেদিকে বাঁক নিতে গেলে পাথরে হোঁচট খায়। মুখ থুবড়ে পড়ে সহসা।

এরপর যে ঘটনাটা ঘটে তাতে আবার বরফের ছ্যাঁকা সারা শরীরে। খুব কাছের রেঞ্জ থেকে গুলি করল কেউ! পড়ে থাকা অবস্থাতেই দেখতে পায় একটা বাইক চলে যাচ্ছে পাশ কাটিয়ে। আরোহী দু’জন।

মুহূর্তের জন্য মাথাটা ফের শূন্য হয়ে যায়। কী হচ্ছে এইসব! কিন্তু এখন এইভাবে এক মিনিট থাকাও নিরাপদ নয়। ভয় পেলে চলবে না, যে করে হোক আগে থানায় পৌঁছতে হবে। দু’হাতের তালুতে ভর দিয়ে উঠে বসে স্বপ্ননীল।

টিলার গায়ে, ছোটোখাটো ঝোপঝাড় থেকে শুরু করে শিমুল পলাশ বাবলা সবই আছে। তবে অন্ধকারে আলাদা করে কিছু বোঝার উপায় নেই। সব মিলিয়ে মনে হয়, একটা প্রকাণ্ড পাথরের চাঁই দাঁড়িয়ে। এখানে ছোটোখাটো জন্তু-জানোয়ার তো আছেই। এমন কী চিতাবাঘও থাকতে পারে।

প্রায় এক-দেড় মিনিট ওইভাবে বসে থাকার পর ব্যাগের মধ্যে রাখা মোবাইলটা বেজে ওঠে। বার দুয়েক রিং হলে শব্দটা সেধোয় নীলের মাথায়। বার করতে করতে কেটে যায়। পর্দায় সুজয় মাহাতো। রিং ব্যাক করতে গেলেই বন্ধ হয়ে যায় ফোন। চার্জ নেই। হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছে এখন। চন্দ্রপুরা স্টেশনে নেমে নেটওয়ার্ক অপারেশনটা যখন ঠিক করল, তখন একবার চার্জ দিয়ে নেবার কথা ভেবেছিল। কিন্তু ওভারব্রিজের ওই ছায়ামূর্তি সব তালগোল পাকিয়ে দিয়েছে। ওই ছায়ামূর্তিই কি তাড়া করেছে ওকে? তাই হবে। ওকে অটো থেকে নেমে পড়তে দেখেই হয়তো সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে চেয়েছে। নেহাত ও হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল তাই। নাহলে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিত বুলেট। আর এইদিকে ওকে হুমড়ি খেয়ে পড়তে দেখে, ওই মক্কেল নিশ্চয়ই ভেবেছে গুলি ঠিক নিশানাতেই লেগেছে।

ঘোর কেটে গেলে চারপাশটায় নজর দেয়। পড়ে যাবার সময় চশমাটা ছিটকে গিয়েছিল চোখ থেকে। সেইজন্যই, ‘সুজয় মাহাতো’ নামটা বুঝতে ওর কসরত করতে হয়েছে। বসে বসেই সামনে হাতড়ায়। পায় না। মোবাইলটা ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ঝুঁকে পড়ে দেখতে থাকে। পথের ধারে একটা খানা মত। গভীরতা এক ফুটও হবে না। ওইখানে খুঁজে পায় অবশেষে।

অটোটা ওইভাবে ছেড়ে না দিলেই ভালো হত। একটু আওয়াজ সহ্য করলে খুব কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হত না। না, জঙ্গলের দেশে এই হঠকারিতা ঠিক হয়নি। এইখানে আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ নয়। যারা এইমাত্র গুলি চালিয়েছে তারা ঘটনাস্থলে ফিরে আসবে না এমন কোনও কথা নেই।

থানার দিকে পা বাড়ায়। খাড়াই পথ উঠে গেছে উপরে। পিঠের ব্যাগটা নিয়ে এগোনো কঠিন। একদম উপরে কয়েক বর্গফুট জায়গা সমতল। মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে যায় সেখানে। টিলার উল্টোদিকটা অন্ধকার নয়। পথ গিয়ে যেখানে সমতলে মিশেছে, সেখানে একটা জোরালো ভেপার।

আলো নীলের ভিতর প্রাণ সঞ্চার করে। দ্রুত পদক্ষেপে নামতে শুরু করে এবার। মিনিট পাঁচ ছয়ের বেশি লাগে না নেমে আসতে। বাঁ দিকে ঘুরলেই ডি-ভি-সি হাসপাতাল চত্বর। সীমানা ঘেঁষা লাশ কাটা ঘর। মর্গটাকে ফেলে ডানদিকে ঘুরলেই থানা।

কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’

তিপ্পান্ন

চন্দ্রপুরা থানা। ঝাড়খণ্ড।

ড্রাইভার দ্বিগু সরেন গেটের কাছেই ছিল। এগিয়ে আসে।

“জিঁ সাব… বলিয়ে...”

দ্বিগুকে খেয়াল করেনি নীল। চমকে ওঠে।

“জিঁ সাব… কিসকো চাহিয়ে আপকো?”

“ও সি সাব হ্যায় ক্যায়া?”

ঝিলম আর সুরিন্দর দুজনেই ছিল বারান্দায়। তারা স্বপ্ননীলকে দেখেছে। ঝিলম উঠে বড় সাহেবের কাছে যায়। ফিরে আসে দ্রুত। পরিষ্কার বাংলায় স্বপ্ননীলকে বলে, “একটু বসুন বারান্দায়। স্যার ফোনে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছেন। শেষ হলেই আপনাকে ডাকবেন।”

একটা চেয়ার এগিয়ে দেওয়া হয়।

গুরুত্বপূর্ণ কথাই বটে। এসপি ফোন করেছেন আবার। দু’দিন হতে চলল, কিন্তু এখনও অব্দি সেরকম কোনও ফিডব্যাক পাননি।

“হ্যাঁ স্যার… বলুন...”

“কোনও ক্লু পাওয়া গেল কি?”

“না স্যার। এখনও...”

এই বাক্যটা শেষ হয় না মাহাতোর। তার আগেই, এসপি’র বাক্য কানে এসে ঝাপটায়, “তাহলে কী চেষ্টা করছেন আপনি! আপনি জানেন আমায় কী শুনতে হচ্ছে অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কাছ থেকে...”

এই কথার কোনও উত্তর মাহাতোর কাছে নেই। দু’এক পলক নীরবতা পালিত হবার পর ধেয়ে আসে এসপি’র পরের শব্দবাণ, “ডু ইউ নো... মি. বিশ্বামিত্র সেন কে ছিলেন...?”

অহেতুক প্রশ্ন, যা উত্তর পাওয়ার আশায় করা হয়নি। করা হয়েছে, ফোনের উল্টোদিকে যিনি আছেন তাকে কড়কানোর জন্য।

“শুনুন মি. মাহাতো, সেন্ট্রাল ফরেন্সিক ল্যাব আর তার ডিরেক্টর…”

এইটুকু বলে এসপি একটু সময় নিয়ে পরের কথাগুলো বার করেন,

“সে এক্স ডিরেক্টর হলেও… আশা করি আপনি বুঝবেন। আই নিড আ পজিটিভ ফিডব্যাক অ্যাজ আর্লি আজ পসিবল...। কোনও রকম সাহায্য লাগলে বলুন… ফোর্স আর্মস বাগাড়া...”

“না স্যার। এক্ষুনি কিছু লাগবে না। লাগলে আমি জানাচ্ছি।”

মাহাতো বুঝতে পারেন না এখনই ‘ফোর্স’ দিয়ে উনি কী করবেন। উনি চাইলেন এবং পাঠিয়েও দেওয়া হল। কিন্তু সেই ‘ফোর্স’ তিনি কোন কাজে লাগাবেন! সবে একদিন হয়েছে, এখনও তদন্তের কোনও দিক-নির্দেশই করা যায়নি। ওইদিকে মাহাতোর শেষ শব্দ দুটো শোনার অপেক্ষা করেননি এসপি। তার আগেই লাইন কেটে দিয়েছেন। অগত্যা, ফোন নামিয়ে আগন্তুককে ডেকে পাঠান দারোগা সাহেব। ধীর পায়ে ঘরে ঢুকে আসে নীল।

“আসুন ভিতরে আসুন...”

উল্টোদিকের চেয়ারটা দেখিয়ে দেন সুজয়, “ইয়েস... আপনার নামটা যেন কী?”

“স্বপ্ননীল মিশ্র। বাবা রুদ্রনীল মিশ্র...”

“বাবার নাম এখন লাগবে না। দরকার হলে জেনে নেব। আপনার ট্রেন তো রিচ করেছে অনেকক্ষণ... এত দেরি হল?”

প্ল্যাটফর্মে নামার পর থেকে কী কী ঘটেছে, সেই সব এখন আর বলতে ইচ্ছে করছে না। শুধু বলে, “অটো পেতে দেরি হল… তাই...।”

“ইয়োর প্রফেশন মিস্টার মিশ্র? কোথায় আছেন আপনি…”

“আমাদের পারিবারিক ব্যবসা...”

“কীসের?”

“মেডিসিন। হোলসেইল অ্যান্ড রিটেলিং। এছাড়াও আমাদের একটা ডায়গনোস্টিক সেন্টার আছে। কলকাতাতেই।”

“আচ্ছা…। বিশ্বামিত্র বাবুর সাথে আপনার রিলেশনটা ঠিক কী?”

“আমায় উনি খুব স্নেহ করতেন...”

বাক্যটা শেষ করতে পারে না নীল, “আর একটু স্পেসিফিক করুন প্লিজ। শুধু স্নেহ...! আর কিছু না...!”

স্পেসিফিক করে নীল, “মূল ব্যবসা কলকাতায় হলেও আমাদের পৈত্রিক বাড়ি নবদ্বীপে। বেশ কিছুদিন আগে, উনি হঠাৎ করে একদিন নবদ্বীপ যান, আমার ঠাকুরদা রত্নাকর মিশ্রের সাথে দেখা করার জন্য। সেই থেকে ওঁর সাথে আলাপ।”

“কেন?... আই মিন... ঠাকুরদার সাথে উনি দেখা করতে গিয়েছিলেন কেন!”

“আপনি চৈতন্য মহাপ্রভুর কথা নিশ্চয়ই শুনেছেন...?”

দুম করে প্রসঙ্গান্তরে অবাক সুজয়। মিনিট খানেক চুপ করে থাকার পর বলেন, “কোন মহাপ্রভু?”

“আমি একজন মহাপ্রভুকেই চিনি।”

একটু কেটে কেটে শব্দগুলো বলেছিল নীল। শব্দের ধাক্কায় প্রভুকে দ্রুত আইডেন্টিফাই করতে পারেন বড়বাবু। “আপনি কী সেই সন্ন্যাসীর কথা বলছেন। যিনি নদীয়ায় জন্ম গ্রহণ করেছিলেন? হ্যাঁ... সে কে না চেনে!”

“তাঁকে নিয়ে একটা গবেষণার কাজ করছিলেন উনি। সেই কারণে গিয়েছিলেন নবদ্বীপ...”

বাক্যটা শেষ না করেই ছেড়ে দেয় স্বপ্ননীল। পুলিশকে এর থেকে বেশি কিছু বলার কোনও মানে হয় না। কিন্তু মাহাতো নাছোড়, “আমাদের কাছে যতটুকু ইনফরমেশন আছে, তাতে এইটা বুঝতে পারছি, ওঁর কাজের সাথে এই মিন রিসার্চের সাথে, আপনি বেশ ভালোভাবে জড়িয়ে আছেন...”

কথাটা বলতে বলতে উঠে দাঁড়ান মাহাতো। মিস্টার সেনের সেই ছোটো ডাইরি, যেখানে কিম্ভুতকিমাকার বাক্যগুলো লেখা। ধরিয়ে দেন নীলের হাতে,

আনন্দ অন্তর্যামী তুমি অনাথবন্ধু হে
গিরিধারী গোকুলনাথ তুমিই গোপালক হে...
সনাতন স্বয়ম্ভু তুমি সচ্চিদানন্দ হে
তপোময় ত্রিলোকনাথ তুমিই ত্রিলোকপালক হে...
অচ্যুত–গদাধর–চিকনকালা–ত্রৈলোক্যনাথ
—কবে শেষ কথা— তাই এ আমার শেষের কবিতা...

সুজয় বলেন,

“কিছু কি বুঝতে পারছেন?”

হাতের লেখাটা দেখেই চেনা যায়। স্যারের। কিন্তু কী লিখেছেন উনি! মানে কী? এইসব আগে তো কোনোদিন কিছু বলেননি! না, নীলও কিছু বুঝতে পারে না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।

টেবিলের উপর ডাইরি রেখে আবার জায়গায় বসেন সুজয়। বেলটা না বাজিয়ে একটা বাজখাই হাঁক দেন দ্বিগুকে।

এসপি সাহেব তো বাত্তেলা ঝেড়েই খালাস। ওইখানে বসে বুঝবেন কী করে, হাজার চেষ্টা করেও, বিশ্বামিত্র হত্যার একটা সলিড ক্লু পাওয়া যাচ্ছে না। সামনে বসে থাকা মক্কেলও কিচ্ছুটি উদ্ধার করতে পারল না ডাইরির সংকেত দেখে।

তিন লাফে দ্বিগু দরজায় এসে দাঁড়ায়, “জি সাব...”

“দু কাপ চা পাঠিয়ে দিন। আপনার দুধ না লিকার? চিনি চলে তো?”

নীল তখনও হাঁ, ডাইরির খোলা পাতার দিকে। ওসি সাহেবের কথা কানে ঢোকেনি। সুজয় আবার বলেন, “আপনাকে বলছি মিস্টার মিশ্র...”

এইবার চোখ তুলে তাকায় নীল, “হ্যাঁ হ্যাঁ আমার কোনোটাতেই অসুবিধা নেই।”

“দুটো লিকার। উইথ সুগার।”

দ্বিগু চলে যায়। ডাইরি বন্ধ করে জায়গামত চালান করেন সুজয়, “কিছু বুঝতে পারেননি, তাই তো?”

না সূচক মাথা নাড়ে নীল, “কোথায় পেয়েছেন এটা?”

“বিশ্বামিত্রের স্টাডিতে। যাই হোক, আজকের রাতটা আপনি থাকবেন কোথায়?”

“আমি বিশ্বামিত্রবাবুর বাড়িতেই থেকে যেতে পারি।”

“সম্ভব নয়। ওঁর বাড়ি আপাতত লক অ্যান্ড কি। চব্বিশ ঘণ্টার জন্য পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। উনি ছাড়া আর কেউ কি আপনার চেনা জানা আছে এখানে?”

“না।”

“ঠিক আছে, রাতটা ইচ্ছে করলে আপনি থানায় থেকে যেতে পারেন।”

থানায়! কিন্তু যাবেই বা কোথায়? মাথার মধ্যে ওভারব্রিজের সেই ভূত এবং বাইক বাহিনী চাড়া দেয় আবার। আচ্ছা ওই বিষয়গুলি ওসি সাহেবকে বলে দেওয়া উচিত নয় কি?

দু-এক মুহূর্ত ভাবার পর বলেই দেয়। দুটো ঘটনাই ডিটেলিং করে যতটা সম্ভব।

চা এবং বিস্কুট নিয়ে হাজির হয় দ্বিগু। রেখে যায় টেবিলে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে সুজয় বলেন, “স্টেশনের লোকটাকে আপনি আইডেন্টিফাই করতে পেরেছেন?”

“না আমি ঠিক বুঝতে পারিনি।”

এতক্ষণে একটা মৃদু হাসি দারোগার মুখে, “হয়ত সেও আপনার মতই, ওভারব্রিজের উপর থেকে রাতের চন্দ্রপুরা পর্যবেক্ষণ করছিলেন। অন্য কোনও উদ্দেশ্য হয়ত তার ছিল না।”

স্বপ্ননীল বলার চেষ্টা করে, বেছে বেছে লোকটা এরকম পজিশন নিয়েই দাঁড়িয়ে রইল কেন, যেখান থেকে একটা আলতো টোকায় যমের দক্ষিণ দুয়ার! কিন্তু, পুলিশের যুক্তি সব সময় ঠোঁটের আগায়, “স্বপ্ননীলবাবু, পিছনে নিশ্চয়ই আপনার দুটো চোখ নেই। দেইইন আপনি এটা অ্যাজামশন করলেন কী করে, যে ঐ লোকটা অনেকক্ষণ ধরে আপনার পিছনেই দাঁড়িয়েছিল? হয়ত আপনি যখন পিছন ফিরেছেন, তখনই সবে মাত্র এসে দাঁড়িয়েছে।”

সুজয়ের যুক্তিতে স্বপ্ননীলের চা পিপাসা চুলোয় যায়। তাও কাপটা হাতে নিয়ে একটা চুমুক দেয়, “আর অন্ধকারে বাইক থেকে গুলি চালানোর বিষয়টা?”

ওসি সাহেব একটা সিগারেট ধরান, বেশ চওড়া করে হাসেন, “এর উত্তরটা আপনার প্রশ্নের মধ্যেই নিহিত মিস্টার মিশ্র।”

“কী বলুন তো?”

“ঐ যে বললেন ‘অন্ধকার’। আপনি চন্দ্রপুরা সম্পর্কে অ্যাওয়ার নন। তাই অবাক হয়েছেন...”

স্বপ্ননীলের মনে হয়, এইসব কী বলছে লোকটা! কাউকে একটা টার্গেট করে আততায়ী গুলি ছুঁড়ছে, তাতেও উনি বিচলিত নন! দু-এক মুহূর্ত থেমে নিজের কথা শেষ করেন মাহাতো, “রাত বিরেতে দু-একটা খুন খারাপি এখানে রোজই হয়। কয়লা মাফিয়াদের এলাকা বুঝলেন না...। আই অ্যাম সিওর, যারা গুলি চালিয়েছে তারা অন্ধকারে আপনাকে চিনতে পারেনি। অন্য কেউ ভেবে ফায়ার করেছে...”

এই কথার পর আর কী বলার থাকতে পারে। স্বপ্ননীল গোঁজ হয়ে বসে থাকে।

“হ্যাঁ যা বলছিলাম... আপনি ইচ্ছে করলে থানাতেই থেকে যেতে পারেন... কাল সকালে, মর্গ থেকে বিশ্বামিত্রর বডি নিয়ে সোজা বার্নিং ঘাটে যাওয়া হবে। আপনি তো জানেনই যে...”

“হ্যাঁ মনে আছে।”

ডিউটি অফিসার বিজিত কোলেকে ডেকে পাঠান সুজয়। বিজিতকে এখনও অব্দি এই কেসটায় জড়াননি ওসি সাহেব। বিজিতের কোমরে প্যান্টটা মনে হয় জুত হয়ে বসেনি। দু’হাত দিয়ে উপরে তুলতে তুলতে দরজায় এসে দাঁড়ায়, “আমায় ডাকছেন স্যার?”

“হ্যাঁ। আপনার ঘরে একটু জায়গা হবে? তাহলে উনি আজ রাতটা ওখানেই কাটাবেন?”

বিজিত ভালো করে দেখে একবার স্বপ্ননীলকে। তারপর বলে, “সে আপনি বললে নিশ্চয়ই হবে স্যার। কিন্তু চেয়ারে বসেই রাত কাটাতে হবে। পুরনো ফাইলে...”

খেয়াল হয় মাহাতোর, ওই ঘরে শতরঞ্চি অথবা খাট পাতার জায়গা নেই। কাগজপত্র আর ফাইলে ঠাসা। অগত্যা সেই মহাদেবকেই ডেকে পাঠাতে হয়।

“আমাকে ডাকছিলেন স্যার।”

স্বপ্ননীলের সাথে আলাপ করিয়ে দেন বড়বাবু। স্বপ্ননীল সম্পর্কে দু’এক কথা বলার পর বলেন, “আজকে উনি এখানেই থাকবেন। আপনার ঘরে একটা ব্যবস্থা হতে পারে কি?”

“নিশ্চয়ই। আমার একটা ক্যাম্পখাট আছে। পেতে দেব। কোনও অসুবিধে নেই।”

হাতঘড়ি দেখেন মহাদেব। এগারোটা বাজতে আট।

“স্যার হাসপাতাল গেটের সামনে রুটি সবজির দোকানটা রাত এগারোটা অব্দি খোলা থাকে। আমি তাহলে সরেনকে বলে দিই…”

“হ্যাঁ বলুন।”

মহাদেব চলে যান। দারোগা সুজয়কে বলেন, “যান, বাইরে সুরিন্দর আছে। ও আপনাকে সব দেখিয়ে দেবে। আজ আর দেরি করবেন না। খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পড়ুন। কাল সকাল সকাল উঠতে হবে।”

স্নান সেরে মহাদেবের ঘরে এসে স্বপ্ননীল দেখে, ক্যাম্প খাট পাতা হয়েছে একপাশে। একটা বালিশও আছে। পিলো-কভারটা কিঞ্চিৎ তেলচিটে। কিন্তু তাতে কোনও অসুবিধা নেই। একবার গা এলিয়ে দিতে পারলেই হল।

টেবিলের উপর সাজানো রুটি সবজি। সামনের চেয়ারটা ফাঁকা। পাশেরটায় বসে আছেন মহাদেব।

“নিন খেয়ে নিন।”

“আপনি খাবেন না?”

“আমার হয়ে গেছে।”

স্নান করার পর সারা শরীর জুড়ে একটা আরাম। রাস্তার উত্তেজনা খানিক প্রশমিত হয়েছে এতক্ষণে। চেয়ারে বসে গোগ্রাসে খেতে আরম্ভ করে নীল। মহাদেব বলেন, “আমার নাইট ডিউটি। শোয়ার উপায় নেই। কাজ আছে। ঘরে আলো জ্বলবে। অসুবিধে হবে না তো?”

আলোতে অসুবিধা হলেই বা কী! পুলিশ থানায় রাত কাটানোর বন্দোবস্ত করে দিচ্ছে এই ঢের। স্বপ্ননীল লাজুক হেসে বলে, “না না আমার কোনও অসুবিধা নেই।”


কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন


এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।

মন্তব্য করুন

লেখক

জন্ম-৮ সেপ্টেম্বর, কলকাতা। ছাত্রাবস্থায় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার মাধ্যমে লেখালেখির শুরু। এই উপন্যাস ছাড়াও লেখকের প্রকাশিত অন্য উপন্যাসগুলি হল— ‘আসলে ভালবাসার গল্প’, ‘রোধবতীর নীল রং’, ‘একে রহস্য দুইয়ে লক্ষ্যভেদ’। দেশ, আনন্দমেলা, কৃত্তিবাস, কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান, কথা-সাহিত্য, বহুরূপী এবং আনন্দবাজার পত্রিকায় ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু লেখা। এছাড়াও বাংলার শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের সম্মান ‘সুন্দরম পুরস্কার’ পান ২০১৪ সালে।

অন্যান্য লেখা

দেখতে পারেন