...এরপর বলবন্ত দুম করে একটা অদ্ভুত কথা বলে,“খুন আমি করিনি সেটা আমি জানি। কিন্তু তুই যে করিসনি সেটা বুঝব কী করে? চিন্তা শুধু নিজের জন্য হয় না রে, তোর জন্যও হয়।”
সত্যি তো বিশ্বামিত্র সেনকে খুনটা করল কে?
সাতান্ন
ফুলওয়ারিতোড়। ঝাড়খণ্ড।
দুই চৈতন্য কথা। আদি ও অনাদি।
কাল, রাতের বেলা চন্দ্রপুরা টাউনে গিয়েছিল আবদুল। টুকিটাকি কিছু কেনাকাটা ছিল। ফেরার পরই মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে যায়।
চাঁদের আলো ঝাপটে এসে পড়েছে নিকানো উঠোনটায়। বাইরে থেকেই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল, বাপজানের খাটিয়াটার উপর কারা যেন বসে আছে!প্রথমে ভাবে পুলিশ বুঝি। আরও খানিক এগোলে বুঝতে পারে, না পুলিশ নয়। তিন মক্কেল। সাল্লু মিঞা, অনন্ত এবং অরবিন্দ।
অরবিন্দ এবং অনন্ত তাদের ঘর থেকে খানিক আগেই দেখেছিল দুগ্ধার মাথায় রাধামাধব মন্দির। এবং তারা এটা ঠিক করে নিয়েছিল, যে তারা হাঁটা পথেই যাবে অনাদির সাথে চূড়ান্ত বোঝাপড়া করতে। সেই কারণে তারা বেরিয়েছিল সাল্লুকে নিয়ে, মেঠো রাস্তাটার হাল হকিকত বুঝে নিতে।
সে যাই হোক, তাদের তিনজনকে একসাথে দেখে আবদুলের মনে প্রশ্ন জাগে, তিনজনে মিলে এইখানে কেন বাপু! কোন মতলবে? বাড়ির সীমানায় পা রাখতে না রাখতে এগিয়ে আসে সাল্লু মিঞা। বিরাট গর্দানখানা নাড়তে নাড়তে বলে, “এমনি ওঁদের নিয়ে একটু বেরিয়েছিলাম। জ্যোৎস্না রাতে নাকি গ্রাম দেখবে। ঘুরতে ঘুরতে চলে এলাম এইদিকে। তোর বাপজান আমাদের বসতে বলে ঘরে চলে গেল...”
“হুমম...”
একটা মাত্র শব্দ আবদুলের।
সাইকেলটা দাওয়ায় রেখে ঘরে যায়। একটা কেরোসিনের লম্প জ্বলছে। পাশের ঘরটা অন্ধকার। আম্মিজান শুয়ে পড়েছে হয়ত। কিন্তু, আব্বুকে কোথাও দেখা যায় না। কোথায় গেল মানুষটা? এদিক ওদিক খানিক চোখ ঘোরাতেই দেখতে পাওয়া যায়। বারান্দার একপাশে, অন্ধকার জায়গাটায় চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন। বোঝা যাচ্ছে, উৎকীর্ণ কান পাতা বাইরের দিকে। সালাউদ্দিনদের কথা শোনার চেষ্টা করছেন।
নিশ্চয়ই খেয়াল করেননি ঘরে কেউ ঢুকেছে। তাহলে দাঁড়িয়ে থাকতেন না ওইভাবে। কাছে এগিয়ে যায় আবদুল। চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করে, “এখানে কী করছ?”
চকিতে পিছন ফেরেন বৃদ্ধ। ঘরের ভিতরেও ঢুকে পড়ছে নাছোড় চাঁদ। আব্বুজানের শ্বেত শুভ্র দাঁড়ি বেশ বুঝতে পারা যায়। হিসহিসিয়ে বলেন, “সাল্লুর সাথে এই লোক দুটো কে?”
“কেন তোমার কী দরকার?”
এর পরে যে কথাটা বলেন বৃদ্ধ, সেটা আসলে উনি বলেন না। সারা জীবনে, একটু একটু করে যে অভিজ্ঞতার সিঞ্চন হয়েছে তাঁর মস্তিষ্কে, তা বলায় ওঁকে দিয়ে, “ওরে সব কিছু শেষ হয়ে যাবে রে... এখনও ভালো চাস তো ঐ কসাই সাল্লুকে ছাড়...। সনাতন গাজীর বটতলা ও একাই শেষ করে দেবে। সাথে আবার এই দুটো জুটেছে !”
আবদুল কোনও কথা না বলে আবার বাইরে চলে যায়। সাল্লু বলে,
“কী রে কিছু না বলে সটান ভিতরে চলে গেলি যে…!”
“একটু দরকার ছিল।”
আতিথেয়তার বহর এইরকম হলে আগন্তুকের পক্ষে বেশিক্ষণ থিতু হওয়া মুশকিল। আরও দু-এক কথার পর চলে যায় সালাউদ্দিনরা। ওদের বিদায় দিয়ে আবদুল ঘরে আসে আবার। আব্বাজান তখনও দাঁড়িয়ে আগের মতই, “এখনও তুমি এইখানে...!”
“শোন আবদুল এই বাড়ি আমার।”
“তাতে কী হয়েছে !”
“আর কোনোদিন যেন এই ত্রিসীমানায় ওদের না দেখি।”
“আমি ওদের ডেকে আনিনি।”
ছেলের সাথে অহেতুক কথা না বাড়িয়ে, অল্প কিছু শব্দে শেষ করেন আব্বাজান, “আর তুইও যত তাড়াতাড়ি পারিস সাল্লুর খপ্পর থেকে নিজেকে সরিয়ে নে।”
বৃদ্ধ হেঁটে চলে যান নিজের ঘরে। স্পষ্টতই উত্তেজিত। বারান্দারচৌকাঠ বেশ উঁচু। আর একটু হলেই হোঁচট খেয়ে পড়তেন। কোনোরকমে সামলে নেন।
আজ সকাল খানিক গড়াতে না গড়াতেই আবার দুগ্ধার পানে হাঁটা দিয়েছে আবদুল। প্ল্যান্টের কাজটা যাওয়ার পর থেকে সময় যেন কাটতেই চায় না। ধনাইকে খড়ভুষি দেওয়া হয়ে গেলে মনে পড়ে দুগ্ধার রাধামাধব মন্দিরের গাছগুলোর কথা। বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল গাছগুলোর কোনও দেখভাল হচ্ছে না। হাতের কাজ সেরে বেরিয়ে পড়ে দ্রুত। আবদুলের নিজের ভিতর কেমন যেন একটা অস্থিরতা। প্রেম, পরিবার সব কিছু তার থেকে কেমন যেন দূরে সরে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। মাথার মধ্যে পাক দিয়ে উঠছে মরা মাছের চোখের মত শূন্যতা। আবদুলের কেন যেন মনে হচ্ছে এই টাল খাওয়া মাথা তাকে আবার ঠিক জড়িয়ে দেবে, সেই দাঙ্গার মত কোনও এক ভয়ংকর পাকচক্রে। যা এই প্রেক্ষাপটে অবশ্যম্ভাবী।
পাহাড়ে উঠতে উঠতে শুনতে পায় খোল করতাল আর নাম সংকীর্তনের শব্দ। নিশ্চয়ই গোসাঁইজি নগর কীর্তনে বার হচ্ছেন দলবল নিয়ে?সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে, কখন যে পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে উঠে আসে আবদুল নিজেই খেয়াল করে না।
হ্যাঁ যা ভেবেছে ঠিক তাই। বলবন্ত সিং ছাড়া মন্দিরে এখন কেউ নেই। গোঁসাইজি ততক্ষণে পাকদণ্ডী পথ বেয়ে মিলিয়ে গেছেন দূরের বাঁকে। বিশ্বামিত্র খুন হয়ে যাওয়ার পর তার দেখা হয়নি বলবন্তের সাথে। তাকে দেখে বলবন্ত এগিয়ে আসে, “কী রে এলি শেষ অব্দি?”
“আমি পরশুদিন দিনও এসেছিলাম। তোর সাথে দেখা হয়নি।”
“পুলিশ তোর কথা জানতে চাইছিল। আমি থানা থেকে ফোন করেছিলাম। ফোন বন্ধ ছিল। তোকে ডেকে পাঠাতে পারে যখন তখন।”
আবদুল তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে, “বাড়ি অব্দি এসেছিল মামারা। ঐ সব নিয়ে ভাবি না। তুইও অত ভাবিস না বলবন্ত। খুন যখন তুই করিসনি তখন তোর একটা চুলও ছিঁড়তে পারবে না পুলিশ।
এরপর বলবন্ত দুম করে একটা অদ্ভুত কথা বলে, “খুন আমি করিনি সেটা আমি জানি। কিন্তু তুই যে করিসনি সেটা বুঝব কী করে ? চিন্তা শুধু নিজের জন্য হয় না রে, তোর জন্যও হয়।”
বলবন্তের কথাটা কেমন যেন একটা মোচড় মেরে আবদুলের বুকের মধ্যে ঢুকে পড়ে। বলবন্ত তো শালা হিঁদুর ছেলে, তাহলে ওর জন্য চিন্তা করতে যায় কোন দুঃখে! বলবন্তের পরের কথাগুলো ভেসে আসে আবদুলের কানে, “আসলে এই রাধামাধব মন্দিরে অনেকদিন ধরে একসাথে আছি তো... তাই...আবার শুনি যে তলায় তলায় ঐ সরস্বতীর সাথেও তুই... তোর কিছু হলে মেয়েটার কী হবে ভেবেছিস?”
এইসব কথা শুনলে আজকাল আবদুলের কেমন যেন অস্বস্তি হয়। অনাদি গোসাঁইও যেদিন শুনেছিলেন, আবদুল সালাউদ্দিনের পার্টিতে নাম লিখিয়েছে সেদিনই বলেছিলেন, “কাজটা তুই কিন্তু ভালো করলি না। একটা মেয়ের সাথে জড়িয়েছিস, আবার ওর দলেও নাম লেখালি! দুটো একসাথে চলে না।”
কথা শুনে রাগ হয়ে গিয়েছিল আবদুলের। সে অনাদির কাছে শোনা কথাই উগড়ে দিয়েছিল অনাদিকে, “তোমার মহাপ্রভু তো দু’দুটো বিয়ে করেছিলেন আবার সন্ন্যাসীও হয়েছিলেন। দুটো একসাথে কী করে সামলেছিলেন উনি? আর উনি পারলেও আমিও পারব।”
কোন কথার সাথে কোন কথা! সে যাই হোক, মহাপ্রভুর কথায় হেসে ফেলেছিলেন অনাদি। উজ্জ্বল গৌর বর্ণের দীর্ঘকায় মানুষটির মুখমণ্ডল জুড়ে ছড়িয়ে গিয়েছিল আলো। মায়াময় অনাদি সেই প্রেমালোক মেখে নিয়েছিলেন সমস্ত শরীরে। সুদূর নীহারিকা হতে ভেসে এসেছিল স্বর, যেই স্বরে এরপর অনাদি আবদুলকে বলে চলেছিলেন ধর্মকথা। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেছিল আবদুল আর ডুবে গিয়েছিল সেই চৈতন্যকথার গহিনে। অনাদি বলেছিলেন,
“কৃষ্ণপ্রেম যাঁহার , তাঁহার অন্য প্রেম আর কীসেরও লাগি !”
রাত্রির অন্ধকার সেইদিন গাঢ় হইতে গাঢ়তর হইতেছে ক্রমে। নিদ্রা সুখে মগ্ন এমনকি জাহ্নবীধারাও। কিন্তু ঘুম নাই বিষ্ণুপ্রিয়ার। নিদ্রিত স্বামীর পদতলে বসিয়া স্বামীর মুখচন্দ্রখানি দর্শন করিতেছেন। কিয়ৎক্ষণ ওইরূপ থাকিয়া চৌরগণ যেরূপ অতি নিঃশব্দে দ্রব্যকে স্থানভ্রষ্ট করে, সেইরূপে পতির চরণ দু’খানি হস্তদ্বারা উঠাইয়া হৃদয়ে ধরিলেন প্রিয়া। তখন বিষ্ণুপ্রিয়া ভাবিতেছেন তাহার মত ভাগ্যবতী ত্রিজগতে আর কেহ নাই। অতিসুখে রোদন আসিল। উষ্ণ নয়নজল একফোঁটা পায়ের উপর পড়িবামাত্র নিমাইয়ের নিদ্রা ভঙ্গ হইল। কথা হইল দুইজনায়। প্রেমালাপ হইল। কিন্তু অতি প্রেমে বিরহ আসিবে। আসিবেই। আসিল।
নিমাই তাঁহার মনকে প্রস্তুত করিয়া ছিলেন পূর্বেই। উদ্ধার করিতে হইবে পতিতে। তবেই উদ্ধারিবে জগত সংসার। বাহির হইতে হইবে পথে। ঘরে বসিয়া থাকিলে চলিবে না। নাম...হরিনাম বিলাইতে হইবে অন্তরীক্ষে-জলে-স্থলে।
প্রিয়াকে বলিলেন— কান্দিচ্ছে মানুষ। তাহাদের সীমাহীন সেই রোদনের কাছে আমাদের এই বিরহ অতীব ক্ষুদ্র। আমি বাহির হইব কিন্তু ফিরিয়া আসিব।
কীরূপে ফিরিবে প্রিয়! কীরূপে!
যেরূপে ফেরে বারিধারা নদী সাগর, কিম্বা পুষ্করিণীর নিকট।
তাহলে তুমি যাইবেই সন্ন্যাসে?
বাষ্প হইয়া বাতাসে আর কতদিন থাকিব? ফিরিয়া আসিব।
তাহলে তুমি যাইবেই সন্ন্যাসে?
কৃষ্ণনাম বুকে লইয়া উবিয়া যাইব আমি। বিন্দু বিন্দু জলধারা হইয়া ফিরিবার তরে।
প্রিয়া কহিলেন,
তুমি যাইবেই যখন সন্ন্যাসে তখন যাও...।যাও।
প্রভু কহিলেন,
কান্দিচ্ছে জগত প্রিয়া... কান্দিচ্ছে সংসার
সেই সন্ন্যাস দিও মোরে, যাহাতে হয় মানব-নিস্তার।
প্রিয়া কহিলেন,
তুমি যাইবেই যখন সন্ন্যাসে তখন যাও।
কৃষ্ণপ্রেম যাঁহার, তাঁহার অন্য প্রেম আর কীসেরও লাগি!
রাত্রির অন্ধকার সেইদিন গাঢ় হইতে গাঢ়তর হইতেছে ক্রমে। নিদ্রা সুখে মগ্ন তখন এমনকি জাহ্নবীও। বিরাট সেই শীত রাত্রির মাঝে শুধু পক্ষীর কম্পিত শরীরের মত জাগিয়া রহিল বিষ্ণুপ্রিয়ার হৃদয়। যাহার কোনও চেতন নাই, কোনও অচেতনও নাই। রহিল শুধু কৃষ্ণপ্রেম। শুধুই কৃষ্ণপ্রেম।
“কৃষ্ণপ্রেম যাঁহার, তাঁহার অন্য প্রেম আর কীসেরও লাগি...।।”
অনাদির কথা মনে হতেই দু’চোখ নিজের অজান্তে ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল আবদুলের। আজ সে বোঝে সেইদিন গোসাঁইজিকে ওই রকম কড়া কথা বলা ঠিক হয়নি। যা গোসাঁইজি পারেন, যা মহাপ্রভু পারেন তা কি সবাই পারে!আবদুল চোখ মুছে তাকায় বলবন্তের দিকে। অন্য কথা বলে, “আজ গোঁসাইজি দল নিয়ে কোনদিকে গেছে রে?”
“কোন দিকে আবার! আজকাল তো বৈগাপাড়ার দিকেই যাচ্ছে রোজ। ঐ সরস্বতীদের গাঁয়ে। আজ যেতে বারণ করেছিলাম। সে কথা কানে নিলে তো ! হেসেই উড়িয়ে দিলেন হো হো করে।”
“কেন! বারণ করেছিলি কেন?”
“কেন আবার! জানিস না সদাশিব, বাপি হাঁসদা এরা কেমন তেগে আছে গোঁসাইজির উপর, সুযোগ পেলেই হামলে পড়বে।”
হ্যাঁ , এইরকম একটা কথা আবদুল কানা ঘুষোয় শুনেছে বটে। যে গোঁসাইজির উপর ‘অ্যাকশন’ হতে পারে। কিন্তু সেটা যে আজকেই হবে এমন কোনও মানে নেই। বলবন্তের সাথে কথা না বাড়িয়ে আবদুল গাছের পরিচর্যায় নেমে পড়ে। বলবন্ত নিজের ঘরে চলে যায়।
চন্দ্রমল্লিকার গোড়ায় খানিক খোঁচাখুঁচি করার পর আবদুল বুঝতে পারে, আজ ঠিক মন বসতে চাইছে না। খুরপি কোদাল ফেলে উঠে পড়ে। পাহাড় থেকে নেমে সোজা রওয়ানা দেয় বৈগাপাড়ার দিকে। মাঠের রাস্তা ধরে।
একজন মুসল্লি হয়ে বৈগাপাড়ায় যাচ্ছে একা একা। কোনও বিপদ হবে না তো?
কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
আটান্ন
ফুলওয়ারিতোড় । ঝাড়খণ্ড।
দুই চৈতন্য কথা। আদি ও অনাদি।
আজও রোজকার মত, আলো ফোটার আগেই ঘুম ভেঙেছিল সরস্বতীর।বিছানা পরিপাটি গুছিয়ে বাইরে এসেছিল। মেটে আলু আর সিমসিদ্ধ খেয়ে দিন কাটছে এখন। তাও ঝাড়পোঁছ, পয় পরিষ্কারের স্বভাব যায় না তার। ঘরে যদি একটা জীর্ণ মাদুরও থাকে, সেটাকে গুছিয়ে রাখা চাই।
আগে পরমেশ্বর আর রতন শুত বারান্দায়। বাপ চলে যাওয়ার পর আজকাল রতন একা শোয়। রতন এখনও ঘুমোচ্ছে। পাশ কাটিয়ে সন্তর্পণে দাওয়ায় এসে দাঁড়ায় সরস্বতী। উঠোন ঝাড়, গোবর ছড়া, গাছে জল দেওয়া অনেক কাজ এখন। সময় নষ্ট করবার জো নেই।
গোয়ালে সবেধন নীলমণি একটাই গরু। সব হয়ে গেলে ওইটাকে নিয়ে আবার মাঠে যেতে হবে। নাহলে বৈগাপাড়া মাথায় করবে হাঁকডাকে।
বাসি কাজকর্ম সেরে যখন গোরু নিয়ে মাঠের পানে বেরিয়ে পড়েছে সরস্বতী বৈগা, তখন দু-একটা পাখি ডাকতে শুরু করেছে সবে।
পলাশ গাছটায় লাল রংয়ের প্রস্তুতি। ডালপালার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ভোরের আকাশ। ওইদিকে তাকিয়ে ভিতরটা কেমন যেন হু হু করে ওঠে সরস্বতীর। এই তো গত অগ্রহায়ণেই অনাদি আর বিশ্বামিত্র এসেছিলেন সদলবলে। গাছের নীচে একখানা মাদুর বিছিয়ে দিয়েছিল সরস্বতী। দলে অতগুলো মানুষ। পাঁচজন মাদুরে বসেছিল ঠাসাঠাসি করে, আর বাকিরা মাটিতে।
নামগান গাইতে গাইতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল সবাই একসময়। বাতাসা আর ভেলিগুড় ছিল ঘরে। একটা থালায় করে তাই সাজিয়ে এনেছিল সরস্বতী। সাথে ঠাণ্ডা জল। তৃষ্ণা মিটিয়ে ভাবে বিভোর হয়ে গান ধরেছিলেন অনাদি। গলা মিলিয়েছিল প্রত্যকে। বিশ্বামিত্রের খোলে উঠেছিল মধুর বোল।
দূরের দুগ্ধা থেকে শুরু করে আশপাশের পাথুরে টিলা, গেয়ে উঠেছিল সুরে সুরে। বিশ্বামিত্র আর অনাদি মাদুরে বসেছিলেন, কিন্তু প্রেমের ভাব কি আর এক জায়গায় তিষ্ঠোতে দেয়? দু’জনেই উঠে পড়েন জায়গা ছেড়ে। ঊর্ধ্ববাহু হয়ে পলাশ গাছকে বেড় দিয়ে দিয়ে গান গাইতে থাকেন অনাদি, আর বিশ্বামিত্রের গলায় ঝোলানো খোলে উঠতে থাকে কৃষ্ণ-নামের বোল। এরপর, দেখাদেখি উঠে পড়েছিল বাকি সবাই। আহা সে যেন এক ‘হরিলুঠের’ মেলা সেদিন, সরস্বতীর উঠোন জুড়ে।
সরস্বতী কিছুতেই বুঝতে পারে না ওইরকম দেবতা সুলভ মানুষটাকে খুন করল কে! আবদুলই কি! ইদানীং আর আবদুলকে বুঝতে পারে না সে। সালাউদ্দিন মোল্লা ওর মত মাথা গরম ছেলেকে দিয়ে যে কোনও কাজই হাসিল করতে পারে।
যাই হোক এইদিকে, মালকিন মাঠের পথে যেতে যেতে কেন থমকে দাঁড়িয়েছিল, বুঝে উঠতে পারেনি অবলা প্রাণীটা। বৈগা পাড়ার ভারি বাতাস ছিঁড়ে অস্থির ডাক ডেকে উঠেছিল। সাথে সাথে সম্বিৎ ফেরে সরস্বতীর। হাঁটতে হাঁটতে লালীর গায়ে হাত বুলিয়েছিল একটু।
ফসল কাটা শেষ। ফলত এখন বৃস্তিত জমির পুরোটাই চারণভূমি। মেঠো পথ ছেড়ে, আল বেয়ে আরও খানিক এগিয়ে যায় সরস্বতী। একটা জায়গায় থামে। গুঁজে দেয় খোঁটা। এরপরই, মাথা তুলে কাকে যেন হেঁটে আসতে দেখে শিশির জড়ানো মাঠখানার পেট চিরে।
কুয়াশাকে যদিও অনেকক্ষণ ধরেই ফ্যাকাশে করে দিতে আরম্ভ করেছিল দিনের আলো, তাও প্রকৃতি কুহেলিকাময়। চোখটা কচলে আরও একবার ভালো করে দেখে সরস্বতী। হ্যাঁ, ঠিক। আবদুলই তো। লম্বা দোহারা চেহারার ওই হাঁটা সেআজ থেকে দেখছে নাকি! মিনিট দুয়েকের মধ্যে মুখোমুখি দাঁড়ায় দুজনে, “কী ব্যাপার হঠাৎ এইদিকে?”
মুসল্লিপাড়ায় সালাউদ্দিন আর বৈগাপাড়ায় মোহান্তি ঠাকুর ফতোয়া জারি করার পর, এই গাঁয়ের লোক ওই গাঁয়ে যায় না। দিনের বেলা তো নয়ই। অবশ্য অনাদি গোসাঁইয়ের কথা আলাদা।
আবদুল বলে, “কেন আসতে নেই?”
“না নেই।”
কথাটা বলে সরস্বতী এদিক ওদিক তাকায়। বোঝার চেষ্টা করে কেউ ওদের দেখছে কিনা।
“আসতে নেই ? তাহলে তুই দুগ্ধায় গিয়েছিলি কেন?”
“এইসব আজেবাজে কথা না বলে নিজের গাঁয়ে ফিরে যা।”
সরস্বতীর কথাকে কোনোরকম গুরুত্ব না দিয়ে সম্পূর্ণ অন্য কথা বলে আবদুল,“আজও মনে হয় তোদের গাঁয়ে গোঁসাইজি এসেছে...”
সরস্বতী কিছু বলার আগেই দূর থেকে একটা গোলমালের আওয়াজ পাওয়া যায়।
বছরের এই সময়টা বড় অদ্ভুত। শিমূল পলাশ ফোটার আগে, তারএকটা প্রস্তুতি চলে পাহাড়ে পাহাড়ে। মিঠে রোদ্দুরে ঘোর লাগে ক্ষণে ক্ষণে। ডগডগে সিঁদুরের মত হু হু করে জ্বলতে থাকে খাঁ খাঁ চারপাশ। আর রুখা মাটির সেই জ্বালা জুড়িয়ে দেয় অনাদির কৃষ্ণনাম।
আজ নামগান গাইতে গাইতে জনা কুড়ির দলটা ডি-ভি-সি চার নম্বর গেটের কাছে থেকে বাঁক নিয়েছিল বৈগাপাড়ার দিকে। গানের দল নিয়ে বার হবার সময় জুতো পরেন না গোসাঁইজি। পিচ রাস্তায় আজকাল খুব একটা অসুবিধা হয় না। পায়ের তলায় কড়া পড়ে গেছে কিন্তু বৈগা পাড়ার পথে এখনও পিচ পড়েনি। খোয়া ফেলে রোলার দেওয়া হয়েছিল বহুকাল আগে। ঘাস জন্মেছে কোথাও কোথাও, আবার বা কোথাও খোয়া উঠে গেছে গরুর গাড়ির চাকায়।
দু’হাত উপরে তুলে মহানন্দে গাইতে গাইতে চলেছেন গোসাঁইজি। এই ভাবরসের কাছে যে কোনও বাঁধাই যে বড় তুচ্ছ। জেগে থাকা একটা পাথরের কানিতে ঘা খেয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত বেরিয়ে আসছিল পা থেকে। কিন্তুসেই পাথরের সাধ্য কি গোসাঁইজিকে থামায়! চারদিকে দাঙ্গার আগুন লাগাচ্ছে ঐ সালাউদ্দিন মোল্লা আর সদাশিব মোহান্তির দলবল। তাঁর যে এখন অনেক কাজ।
মহানামে আকাশ বাতাস ভরিয়ে, বৈগা পাড়ার দিকে দিব্যি এগোচ্ছিল গোসাঁইয়ের দল। গোল বাঁধে বৈগাপাড়ার মন্দিরের হাতায় সেই দল ঢুকে পড়তেই।
ছোটজাতের মানুষের ঠাকুরদালানে ওঠা বারণ। কিন্তু বাপি হাঁসদা এবং তার শাগরেদের বেলায় সে সব নিয়মের বালাই নেই। বাপি আর তারসাঙ্গপাঙ্গরা ঠ্যাং নাড়াচ্ছিল উপাসনা ঘরের সিঁড়িতে বসে। ওইদিকে সদাশিব মোহান্তি সকালবেলার পূজা-অর্চনা সেরে ঠাকুরদালান লাগোয়া ছোটো ঘরটায় বিশ্রাম নিচ্ছিল খানিক।আর, পুবের শিরিষ গাছটায় বসে একখানা কোকিল, রোদের ভিতর ঢুকিয়ে দিচ্ছিল আসন্ন চৈত্রের হুতাশন।
সবকিছু বেশ শান্তি কল্যাণই ছিল। কিন্তু হাঁসদার কানে খোল করতালের আওয়াজ যেতেই লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় যা কিছু শান্তির আয়োজন। ক্রমশ এগিয়ে আসা কৃষ্ণনাম শুনেই দম দেওয়া পুতুলের মত একটা লাফ দেয় বাপি হাঁসদা। সবাইকে চোখের ইশারায় প্রস্তুত হওয়ার কথা বলে নিজে ছুটে যায় মোহান্তির ঘরে। শুয়ে থাকলেও সজাগই ছিল মোহান্তি। বাপির পায়ের আওয়াজে লাফিয়ে ওঠে, “কী হয়েছে রে?”
“ঐ শালা গোসাঁইজির দল আজকেও এসেছে...”
বাপির কথা শেষ হওয়ার আগেই যা বোঝার বুঝে যায় মোহান্তি। ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে, “মাল নিয়ে বেরিয়ে আয় আমার পিছন পিছন। আজ ঐ হারামিরকৃষ্ণনাম ঘুচিয়ে দেব জন্মের মত।” পাঁচখানা পেল্লাই সিঁড়ি ভেঙ্গে ঠাকুর দালানে নামা-ওঠা করতে হয়। দ্রুত নামাবলীখানা গায়ে জড়িয়েতিনলাফে সেই সিঁড়ি ভাঙে মোহান্তি। নুড়ি বিছানো বাগানের পথটুকু যেন উড়ে যায়। তারপর এক হ্যাঁচকায় ফটক খুলে দাঁড়ায় পথের মাঝখানে।
খোয়াই টিলার পাশেই বুড়ি বটতলা। পথের বাঁকে শীতল পাটি বিছিয়ে রেখেছে প্রাচীন বৃক্ষ। অনাদি গোঁসাই তাঁর দলবল নিয়ে সেই ঠাণ্ডা ছায়া পেরিয়ে মন্দিরের কাছে চলে আসেন দ্রুত।
এইদিকে, পথের মাঝে দাঁড়িয়ে সদাশিব মোহান্তি। সে চিৎকার করে থামার নির্দেশ দেয় গানের দলকে। কিন্তু খোল আর বোল দুই তখন কাঁপিয়ে দিচ্ছে পাথুরে টিলা। আর, খোয়াই টিলার বিরাট শরীর মহানন্দে ফিরিয়ে দিচ্ছে সেই হরিনামের প্রতিধ্বনি। ধ্বনি আর প্রতিধ্বনিতে তখন ক্রমেই নেশাতুর হয়ে পড়ছে বৈগা পাড়া।
অনাদির ঘোর লাগা চোখ যেন দেখেও দেখতে পায় না দস্যুকে। মাতোয়ারা খোলের তাল তখন তাঁর কানে গুঁজে দিয়েছে তুলো। সদাশিবকে উপেক্ষা করে এগিয়েই যাচ্ছিলেন অনাদি। কিন্তু ততক্ষণে সদাশিবের পিছনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে বাপি হাঁসদা এবং তার জনা পাঁচেক শাগরেদ। প্রত্যেকের হাতে চকচকে হাঁসুয়া। যার এক কোপে একটা মানুষকে দু’আধখানা করে ফেলতে সময় লাগে না।
শ্রীগোরাঙ্গসুন্দর যায় নাচিয়া নাচিয়া।
আবেশে অবশ অঙ্গ ঢলিয়া ঢলিয়া ।।
চরণেতে বাজে নূপুর, রুনু ঝুনু বোলে।
মালতীর মালা, বিনোদিয়া গলে দোলে।।
জগাই মাধাই সারানিশি মদ্যপান করিয়া অচেতন হইয়া নিদ্রা যাইতেছে। কীর্তনের বোল শুনিয়া তাহাদের নিদ্রাভঙ্গ হইল। প্রহরীকে দিয়া নির্দেশ পাঠাইল কীর্তনোন্মত্তদের স্থান ত্যাগ করিবার। কিন্তু তাঁহারা পতিত দু’ভাইকে উদ্ধার করিতে আসিয়াছে। সামান্য প্রহরীর আদেশ তাঁহারা শুনিবে কেন?
দ্বিগুণ করিয়া আরও বাড়ায়ে উল্লাসে।
হরি হরি বোল ধ্বনি গগনে পরশে।।
অবশেষে, জগাই মাধাই হরি বলিল বটে। কিন্তু তাহা অতি সহজে নয়। রক্ত ঝরিল।ভারি হইল বাতাস। ভক্তজনের শোণিতধারার লাজে রাঙ্গা হইল স্বয়ং জাহ্নবী। সচকিত হইল নবদ্বীপবাসী। শঙ্কিত হইল তাঁরা। কিন্তু কৃষ্ণনাম থামিল না।
মারিলি কলশীর কানা সহিবারে পারি।
তোদের দুর্গতি আমি সহিবারে নারি।।
মেরেছিস মেরেছিস তোরা তাহে ক্ষতি নাই।
সুমধুর হরিনাম মুখে বল ভাই।।
নবদ্বীপবাসী স্তম্ভিত হইয়া দেখিল কীরূপে, ধীরে ধীরে বীজমন্ত্রের বশ্যতা স্বীকার করিয়া লইল, দুই দারুণ দুর্বিনীত। জগাই আর মাধাই।
সেদিন মহাপ্রভু নিরস্ত হননি আজ অনাদি কেন হবেন! তবে, অনাদির দলেও সবাই অনাদির মত নয়। ভাবরস পান করে, গোসাঁইয়ের মত নেশা করতে সবাই কি আর পারে? পারে না। যাদের পুরো ঘটনা নজরে এসেছিল তাদের মধ্যে থেকে একজন এগিয়ে এসে গোঁসাইজির হাত ধরে থামায়। গোসাঁইজি থামতেই সহসা স্তব্ধ হয়ে যায় চরাচর। স্তব্ধ হয়ে যায় খোয়াইয়ের স্পন্দন। সদাশিবের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসেন অনাদি। আধা সমাহিত অবস্থায় ‘আপনি’ নয় ‘তুমি’ করে সম্ভাষণ করেন দস্যুকে, “কী হে সদাশিব দলবল নিয়ে আজ কোন রণে নামলে হে। খোলের আওয়াজে ভয় পেয়েছ বুঝি?”
“অনেক হয়েছে গোসাঁই। এইবার ফিরে যাও।”
স্মিত হাসি অব্যাহত গোসাঁইয়ের মুখে, “ না সদাশিব ভুল। হয়নি। কিছুই হয়নি এখনও। তবে আমি জানি হবে, এইবার হবে।”
বাপি হাঁসদা পারলে এই মুহূর্তে হেঁসো দিয়ে কুপিয়ে দেয় অনাদিকে। সদাশিব তাকে চোখের ইশারায় বারণ করে। ফের তাকায় গোসাঁইয়ের দিকে। সাপের মত হিসহিসায়, “কী হবে গো গোঁসাই?”
“দীক্ষা। বৈগাপাড়ার সকলের, আজ নয় কাল দীক্ষা হবে, কৃষ্ণমন্ত্রে। প্রভুর শ্রীচরণের দাস হবে সবাই।”
“তা সে দীক্ষা কে দেবে গো গোসাঁই। তুমি? হা হা হা...”
“আমি কেন দেব? স্বয়ং তিনিই দেবেন আমার হাত দিয়ে।”
সদাশিবের পিছন থেকে গর্জন করে ওঠে হাঁসদা, “ঐ হাতটাই তোমার কেটে বাদ দিয়ে দেব গো গোসাঁই।”
সদাশিব কপট ধমক দেয়, “আঃ বড় বেশি মাথা গরম তোর বাপি।” কথাটা বলে ফের ঘুরে তাকায় অনাদির দিকে, “বলি, মুসল্লির ছাওয়ালরে নিয়ে যে ফষ্টিনষ্টি করে মন্দিরে বসে, তার থেকে ধম্মো শেখার দরকার নেই বৈগা পাড়ার মানুষের। গোসাঁই তুমি ফিরে যাও নিজের জায়গায়।”
উত্তরে কোনও কথা না বলে মৃদু হাসি ফিরিয়ে দেন অনাদি। ওই হাসিই যেন বারুদে আগুন দেয়। হেঁসো হাতে লাফ দিয়ে এগিয়ে আসে বাপি। কিন্তু বাপির দিকে চেয়েও দেখেন না অনাদি। তিনি এক স্বপ্নালু ঘোরে নেচে নেচে বলে যান,
“পিরীতি বিষম জালা/ পাগল কৈল আমায়, চিকন কালা।
অন্তরে প্রেমের সিন্ধু/ আঁখি বহি পড়ে বিন্দু/ বন্ধু, কুলশীল ধরম নিলা।
কথা কহিবারে যায়/ কণ্ঠরোধ হয়ে যায়/ এতে বাঁচে কি কুলবালা।
বদন পানে চেয়ে রয়/ নয়ন জলে ভেসে যায়/ চাঁদবদনে চাঁদের আলা।।”
এতখানি বলে মুহূর্তটাক সময় নিয়ে আবার বলতে শুরু করেন অনাদি, “ওহে মোহান্তি তোমার সাধনা মিথ্যা। নকল ধর্মকে জলাঞ্জলি দিতে না পারলে তাঁকে যে পাওয়া যায় না মোহান্তি। তুমি যে ধর্মের কথা বলছ সেই ধর্মকে ছুঁড়ে ফেলতে না পারলে চিকনকালাকে তো পাওয়া যাবে না।”
আর পারে না সদাশিব। বাপির হাত থেকে হাঁসুয়াখানা কেড়ে নিয়ে গলায় ঠেকায় অনাদির, “আমাকে ধর্ম শেখাতে গেলে এক কোপে ধড় থেকে মুন্ডুখানা নামিয়ে দেব তোমার।”
অনাদি এক আশ্চর্য মানুষ। এরপরেও, মৃদু হাসিখানা ঝুলিয়ে রেখেই বলেন, “তুমি যদি ভাব তোমার এই অন্তঃসারশূন্য আস্ফালনে অনাদি গোঁসাই ভয় পাবে, তাহলে তুমি মূর্খের স্বর্গে বাস করছ হা হা হা...।”
মাথার মধ্যে যেন বিস্ফোরণ ঘটে সদাশিবের। “তবে রে হারামির বাচ্চা...!”
এইদিকে ভীষণ একখানা গোলযোগের আঁচ পেয়ে মানুষজন ভিড় জমাতে শুরু করেছিল বৈগাপাড়ার মন্দিরের সামনে। সেই জমায়েতের পিছন দিক থেকে একটা চড়া কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়া যায় হঠাৎ। “হেই সদাশিব সাবধান...”
হাঁসুয়া সমেত যে হাত শূন্যে উঠে গিয়েছিল তা সহসা থমকে যায়। চোখের পলকে ভিড় ঠেলে সামনে এসে দাঁড়ায় আবদুল সামাদ। সিংহ বিক্রমে। “তোর সাহস যে বড় কম নয় রে মোহান্তি! গোসাঁইয়ের গায়ে হাত তুলতে যাস!”
প্রথমে চোটে অবাক হয়ে গেলেও দ্রুত সামলে নেয় মোহান্তি এবং তার দলবল। বাপি তেড়ে আসে আবদুলের দিকে। আবদুল আরও বড় করে হুংকার দেয়। “এই হাঁসদা তফাৎ যা শুয়োরের বাচ্চা। আমার সাথে চোটপাট করার চেষ্টা করিস না। সোজা খুলি উড়িয়ে দেব।”
বাপি হাঁসদা এমনিতে বেশ ভিতু প্রকৃতির কিন্তু সদলবলে থাকলে সে বাঘ্রশাবক। বেশ গলা তুলেই বলে, “কী করবি তুই অ্যাঁ! শালা মুসল্লির ছাওয়াল, বাঘের গুহায় ঢুকে বাঘকেই তড়পাচ্ছিস হারামজাদা!”
“বাঘ কোথায় রে! আমি তো শেয়াল ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না তোদের এখানে।”
উপস্থিত জনতার মুখে রা নেই। দানবের মত চেহারার আবদুলেরসামনে যেন কিছু বামন দাঁড়িয়ে আছে হতবুদ্ধি হয়ে।
এদের মধ্যে যারা আবদুলকে চেনে, তারা অবশ্য আবদুলের কথা এবং বাচনভঙ্গিতে খুব একটা অবাক হয়নি। কিন্তু যারা চেনে না তারা হতবাক এতজনের বিরুদ্ধে একজনের এই দাপট দেখে। বাপি চিৎকার করে বলে ওঠে, “শালা মুসল্লি! আজ তোর বাপ অনাদি, আর তুই, দুটোকেই একসাথে কবর দেব রে খাঙ্কির ছাওয়াল...”
আবদুলকে, বাপি এবং তার শাগরেদরা হাঁসুয়া হাতে ঘিরে ধরে। হাঁসদা হুঙ্কার দেয় ‘জয় শ্রী মোহান্তি ঠাকুরের জয়।’ ভীমনাদের সাথে সাথে হাঁসুয়াগুলোও শূন্যে উঠে যায়। কিন্তু চকিতে এমন দু’খানা তীব্র আওয়াজ পাওয়া যায় যাতে সহসা থমকে যায় সমস্ত কার্যক্রম।
আজও বার হবার সময় গ্লক রিভলভারটা সাথে নিয়ে বেরিয়েছিল আবদুল। কিন্তু এমনভাবে কাজে লেগে যাবে ভাবে নি। চক্রব্যূহে বন্দি হবার সাথে সাথে আবদুল চকিতে তার পকেট থেকে বার করে ফেলেছিল জাত কেউটের বাচ্চাটাকে।
বৈগাপাড়ার মন্দিরে যে ধাতব ঘণ্টাখানা ঝোলে সেটা বেশ বড়। ঘণ্টার দিকে তাক করে গুলি চালিয়ে দিয়েছিল আবদুল। ভিড়ের ফাঁক দিয়েও নিশানায় অব্যর্থ সে। যে দু’খানা আওয়াজ পাওয়া গিয়েছিল, তার একটা গুলির আর একটা ঘণ্টাধ্বনির।
আবদুল এবং অনাদি গোসাঁইকে ঘিরে রাখা দস্যুর দল যখন, দ্বিতীয় শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে তাকাল মন্দিরের দিকে, তখন দেখা গেল, মেঝেতে লুটোপুটি খাওয়া বেলগাছের ছায়া ফালা ফালা করে দোল খাচ্ছে পবিত্র ঘণ্টা।
“শালা আর একটু বাড়াবাড়ি করলে কলজে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেব হারামির বাচ্চা। চিনিস আমায় !”
রিভলভারের সামনে কেরামতি করবে এতখানি মূর্খ বাপি নয়। অনাদি এবং আবদুলকে ছেড়ে পিছিয়ে আসে তারা। সদাশিব প্রথমটা বেশ ব্যোমকে গেলেও অল্প সময়েই নিজেকে সামলে নেয়। চোয়াল চাপা কণ্ঠে বলে ওঠে, “কাজটা কি ঠিক করলি রে মুসল্লির ছাওয়াল? হিঁদুর মন্দিরে আঘাত করলি!”
ঘণ্টায় তাক করেছিল আবদুল, মন্দিরে ‘আঘাত’ করার জন্য নয়। তার মনে হয়েছিল ওইখানে তাক করতে পারলে খুব সহজেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। ওইদিকে বলে যায় মোহান্তি, “শোন আবদুল… কান খুলে শুনে রাখ... ঝড় উঠবে। খুব শিগগিরি ঝড় একটা উঠবে। আর সেই জন্য দায়ী থাকবি তুই। পুড়িয়ে সব ছারখার করে দেব। এত বড় হিম্মত তোর মুসল্লির ব্যাটা যে তুই হিঁদুর ঠাকুরঘরে হাত বাড়াস...!”
আবদুল এইসবে দমার পাত্র নয়। সে খুব একটা যুতসই উত্তর দিতে যাচ্ছিল কিন্তু একটা সুতীক্ষ্ণ কণ্ঠে থামতে হয় তাকে।
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
মন্তব্য করুন