হরিপুর লাইনের একটা ছোট্ট গ্রাম। সে আমার আরেক জীবন। কার্তিক কেন যে তার কাছে নিয়ে গেছিল জানি না। তার যাওয়া-আসা ছিল। সে-ই দেখিয়েছিল সে রাস্তা। একজন সাধক। তবে বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। বাইরে থেকে একেবারে সাধারণ মানুষ। তবে ভিতরে অন্য কেউ রয়েছে। তার ঘরে ঢোকার সঠিক কোনো রাস্তাই নেই। এর ঘর দিয়ে, ওর ঘর দিয়ে ঢুকে, কীকরে যে অন্য একটা ঘরে এসে উঠলাম বুঝতেই পারলাম না। যখন এসেছি দেখি তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মন্ত্র পড়ছেন। কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মন্ত্র পড়ে বলে জানতাম না। এখন দেখছি উনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আমাকে দেখে একই কথা বললেন। যা আমি আগে বলেছি। বলেই বললেন, তুমি পরাধীন, তোমার কোনো স্বাধীনতা নেই। তোমাকে চালনা করছে অন্য কেউ।
এসব তো সেই সময়ের কথা যখন ছেলেবেলা ছিল। ছেলেবেলা কেননা তখন পয়সাকড়ির খুব একটা হিসাব আসেনি মনের মাঝে। কোথায় গেলে কী পাব আর কী পাব না তেমন কথা মাথায় আসতই না। তখন লোকের ঘরে রাতের বেলায় পাথরে রং লাগিয়ে ফেলে আসতাম দরজার সামনে। মানে যারা যারা চাঁদা দিতে চাইত না তাদের ঘরে। তারপর দেখো কাণ্ড। সকাল হল আর শুরু হয়ে গেল গালাগালি খিস্তির বহর। কে করল তুকতাক? কে রেখে গেল তার ঘরের সামনে তেল সিঁদুর। আর তার সাথে যদি দুটো জবা ফুল ফেলে রাখতাম তবে তো কথাই নেই। দে খিস্তি দে খিস্তি, কার সাথে কার কতটা সদ্ভাব আছে তখনই বোঝা যেত।
এখন মনে হচ্ছে টেবিল থেকে সে-পাথর যেন উপরের দিকে উঠে যেতে চায়। কিছুতেই সে আর টেবিলে থাকবে না। তাকে ঠিক শাসন করে বসিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু বাবা এটা আমি কি দেখছি। আমার ভূত-ভবিষ্যৎ সব বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। ঘেঁটে যাচ্ছে আমার বর্তমান। একটা পাথর কীকরে ভেসে যেতে পারে? তার কী প্রাণ রয়েছে। বাবা বলে ডাকলাম। কেউ এল না। দু-বার ডাকলাম, তিন বার ডাকলাম, কেউ এল না। উঠে গিয়ে খুঁজতে শুরু করলাম। কিন্তু কাউকেই ঘরে পেলাম না। বাবা গেল কোথায়। এই তো ছিল ঘরে। আমাকে রেখে কি কিছু আনতে গেল নাকি? আমি হয়তো ঘুমোচ্ছিলাম। ফিরে এলাম। বসলাম সোফায়, সামনে পাথরখানি। সে যেন কিছু একটা বলতে চায়। জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে অথচ মনে ভয়, ঠিক যেন একটা গিল্টি ফিলিং। আমি হয়তো কিছু একটা করে লুকিয়ে রেখেছি। তাই তার সামনে বসে থাকাও দুষ্কর হয়ে উঠছে। আবার বাবাকে খুঁজতে গেলাম। জানি বাবা ঘরে নেই তাও যেন জেনে একটা নাটক করা। জানি ঘরে নেই তাও ঘরেই খুঁজে যাচ্ছি বাবাকে। এইজন্যই নাটককে আমি ঘৃণা করি, আর ঘৃণা করি কবিদের। শালারা যা খুশি লিখে যায়, মানে যায় ভাঁড় মে। যে পড়বে সে বুঝবে।
এখন এ-ঘর ও-ঘর করে খুঁজে যাচ্ছি বাবাকে। বাবা নেই কিন্তু এ-ঘর থেকে ও-ঘরের দূরত্ব যেন অসীমে পৌঁছেছে। ঘর কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। আমি যেন একটা অনন্ত সময় ধরে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে চলে যাচ্ছি। সেখান থেকে আবার অন্য ঘরে। একটা দেয়াল থেকে আরেকটা দেয়ালের কতটা দূরত্ব হতে পারে? সেটা কি মেপে দেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাকিয়ে দেখছি মনে হচ্ছে ওই যে ওইখানে আরেকটা ঘরের আলমারি। তার পাশে জানালা। এখান থেকে কতদূর, যেন হেঁটে পেরোনো আমার দ্বারা আর হবে না। আমি জানালাটার কাছে যেতে পারলে বাইরেটা দেখতে পাব। এই দশ তলা থেকে বাইরেটা আমার ভীষণ প্রিয়। কিন্তু এত দূরে হয়ে গেল কীভাবে?
কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
নয়
—তোর একটা দশা চলছে। সাড়ে সাত বছরের দশা। সাড়ে-সাতি। যা ঠিক সবার জীবনেই একবার-না-একবার আসবেই। তখন সব উলটো হবে। যা করতে চাইবি তার ঠিক উলটোটা হয়ে বসবে। আমার জীবনে কি কিছু এমন হয়নি ভেবেছিস। অনেক অনেক।
কার্তিক বলছিল আর আমি না শোনার ভান করে তাকিয়ে ছিলাম অন্য দিকে। তাও সে বলে যাচ্ছিল এইসব বুজরুকি কথাবার্তা। বিরক্ত লাগছিল অথচ কী-বা করার, বন্ধু যখন সহ্য করতে হবে। শেষে না পেরে বললাম, কী চাই বলতো তোর?
হরিপুর লাইনের একটা ছোট্ট গ্রাম। সে আমার আরেক জীবন। কার্তিক কেন যে তার কাছে নিয়ে গেছিল জানি না। তার যাওয়া-আসা ছিল। সে-ই দেখিয়েছিল সে রাস্তা। একজন সাধক। তবে বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। বাইরে থেকে একেবারে সাধারণ মানুষ। তবে ভিতরে অন্য কেউ রয়েছে। তার ঘরে ঢোকার সঠিক কোনো রাস্তাই নেই। এর ঘর দিয়ে, ওর ঘর দিয়ে ঢুকে, কীকরে যে অন্য একটা ঘরে এসে উঠলাম বুঝতেই পারলাম না। যখন এসেছি দেখি তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মন্ত্র পড়ছেন। কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মন্ত্র পড়ে বলে জানতাম না। এখন দেখছি উনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আমাকে দেখে একই কথা বললেন। যা আমি আগে বলেছি। বলেই বললেন, তুমি পরাধীন, তোমার কোনো স্বাধীনতা নেই। তোমাকে চালনা করছে অন্য কেউ। শুনে মনে হয়েছিল আচ্ছা করে কিছু একটা শুনিয়ে দি, কিন্তু তখন কাজবাজ নেই। গেছি কিছু একটা সুরাহা করতে। সেখানে কি যা তা বলা যায়?
—কী দেখলে আসার পথে?
—কই কিছু তো তেমন দেখিনি।
—ভালো করে মনে করে দেখো, আসার সময় রাস্তায় কী কী দেখেছিলে।
—আসার সময় রাস্তা দেখেছি। বাস দেখেছি। বাস থেকে নেমে একটা গাছ দেখেছি।
—গাছ, ব্যাস আর কিছু না।
—আর কিছু বলতে গাছের তলায় যেমন হয়, তেল সিঁদুরে রাঙানো কিছু পাথর ছিল মনে হল?
পাথর কত পাথর তো ফেলে এসেছি পথে। সেই কোন ছেলেবেলা থেকে এই সদ্য যৌবন পর্যন্ত। তেমনই একটা পাথরের সামনে দাঁড়িয়ে একদিন মিষ্টি বলেছিল প্রণাম করতে পারছ না। বলেছিলাম, কাকে প্রণাম করব? সে বলেছিল, কেন দেখতে পাচ্ছ না, শালগ্রাম শিলা। হেসেছিলাম, কোনো উত্তর করিনি। সেই ছেলেবেলার কথাই মাথায় এসেছিল।
তবে এখন চুপ করে কিছু না বলতে পারার কষ্টই আমাকে চালনা করছে বলতে গেলে। সেভাবে দেখলে পরাধীন। ফিরে এসে বাবাকে বলেছিলাম তার কথা। বাবা বলেছিল, দাঁড়িয়ে ছিলেন? বলেছিলাম, হ্যাঁ। বাবা আর বিশেষ কিছু বলেননি। কার্তিককে জিজ্ঞাসা করেছিলেন কোথায় সে-গ্রাম?
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই,ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
মন্তব্য করুন