পাঁচ দশক পেরিয়েও ‘শোলে’ কেবল একটি সিনেমা নয়, এটি এক যৌথ স্মৃতির মন্দির। চায়ের দোকান থেকে প্রেক্ষাগৃহ—যেখানেই বাজে গব্বরের কণ্ঠ, সময় থেমে যায়। রমেশ সিপ্পির এই কালজয়ী ছবি আজও প্রশ্ন তোলে—আমাদের হারিয়ে যাওয়া একত্রতার স্মৃতি কি ফিরে আসবে?
বাজারের মোড়ে ছোটো একটি চায়ের গুমটি। তার সামনে ছোটোখাটো এক জটলা। মাঝখানে রয়েছে ব্যাটারি চালিত একটি টেলিভিশন। তপ্ত চায়ের ধোঁয়ার ফাঁকে ভেসে আসছে পরিচিত কণ্ঠস্বর, গব্বর সিংয়ের ভয়াল প্রশ্ন, “কিতনে আদমি থে?” রবিবারের অলস বিকেলে সেই টেলিভিশনের সামনে ক্রমশ বাড়তে থাকে ‘আদমি’র সংখ্যা। দেখলে মনে হয় সময় থেমে গেছে। একটি সিনেমা, যা মুক্তি পেয়েছিল পাঁচ দশক আগের অন্যরকম এক পৃথিবীতে, আজও একত্রিত করে মানুষকে। মানুষ কি এতই স্মৃতি ভালোবাসে? ফেলে আসা টুকরো টুকরো গল্পগুলো জোড়া লাগাতে গিয়ে দাঁড়ায় এই প্রকাণ্ড সিনেমার মুখোমুখি? আমাদের ঐতিহাসিক চেতনাকেও শোলে যেন প্রশ্ন করে চলেছে—“কিতনে আদমি থে?”
তর্কাতীতভাবে ভারতবর্ষের সর্বকালের জনপ্রিয়তম এই ছবি স্বাধীনতার মাত্র আঠাশ বছর পরে ১৯৭৫ সালের স্বাধীনতা দিবসের দিন মুক্তি পেয়েছিল। তারপরে কেটে গেছে পাঁচ দশক। আমূল বদলে গেছে দেশ, সমাজ, অর্থনীতি। বদলে গেছে বিনোদনের মাধ্যম ও বিনোদনের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী। বিগত রূপকথার মতো এখনও থেকে গেছে রমেশ সিপ্পির স্বপ্নের ছবি শোলে। গ্রাম শহর মফস্সলের কোনায় কোনায় পৌঁছে গেছে ছবির একেকটা সংলাপ, একেকটা চরিত্র। ভাঙাচোরা প্রেক্ষাগৃহের প্রেতস্বরের মতো, আমাদের আটপৌঢ়ে অবচেতনে এখনও রয়েছে পাঁচ দশক আগের সেই স্ফুলিঙ্গ। এই ছবি দেখেননি এমন মানুষ যেহেতু হাতেগোনা, তাই এর বহুলচর্চিত গল্প বা সংলাপ নিয়ে কথা বলা নিষ্প্রোয়জন। বরং বিস্মিত লাগে এটা ভাবলে যে নিছক একটি সিনেমা দিনে দিনে জনশ্রুতিতে কিংবা দর্শকের অনাবিল মুগ্ধতায় লীন হতে হতে কীভাবে একটি মিথ হয়ে উঠল! হয়ে উঠল এপিক! হয়ে উঠল সিনেমার থেকেও বড়ো কিছু!
কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
যৌথতার প্রতিচিহ্ন হিসেবে থেকে গেছে শোলে। স্মৃতিতে আছে কবেকার মফস্সল, বোধহয় নব্বই দশকে, একান্নবর্তী পরিবারে দুপুরের খাওয়াদাওয়া সারতে সারতে হঠাৎ ভীষণ শোরগোল। জানা গেল টিভিতে শোলে দিয়েছে। একটাই চ্যানেল, একটাই টিভি, দর্শক অনেক। শুনশান হয়ে গেল বাড়ি। শুনশান হল পাড়া। কেবল একটা ঘরের ভিতরে সেঁধিয়ে গেলো লোকগুলো। একটা ছোটো বাক্সের ভিতরের গুপ্তরাস্তা নিয়ে যেন চলে যাওয়া গেল রামগড়ের সেই কৌম জীবনে। আমাদের চিরকালের ড্যাবডেবে তাকিয়ে থাকা সেই প্রেম-বন্ধুত্ব-প্রতিহিংসার মোড়কের দিকে। হাসি-কান্নার ডায়ালেকটিক পৃথিবীতে শোলে নিয়ে এসেছিল যৌথতার অলীক উদ্যাপন। কমিউনিটি ভিউয়িংয়ের এক অত্যাশ্চর্য ম্যাজিক।
শোলে মানেই যেন সেটা একবারের বেশি দেখাটাই নিয়ম। ছবিটা কতখানি মৌলিক তা নিয়ে এই দেশের সাধারণ দর্শক কখনোই খুব একটা মাথা ঘামাননি। রুক্ষ্ম ল্যান্ডস্কেপ, প্যানারোমিক শট, ঘোড়ার দৌড়, ওভারটোন সহিংসতা, রিভেঞ্জ ট্র্যাপ, দীর্ঘ ক্লোজআপের ব্যবহার স্প্যাগেটি ওয়েস্টার্ন ঘরানার কথা তীব্রভাবে মনে করিয়ে দিতে বাধ্য। গব্বর সিং যে সার্জিও লিওনের তৈরি ভিলেনের রেপ্লিকা, সিনেমার ঘটনা, গতি এবং তার সপ্রতিভ সম্পাদনা যে প্রকটভাবে পশ্চিমি প্রভাবিত সে নিয়ে তর্কের কোনো অবকাশ নেই। সেভেন সামুরাই, ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন দ্য ওয়েস্ট, দ্য ম্যাগনেফিসেন্ট সেভেন, নর্থ ওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ারের মতো সিনেমার অনিবার্য প্রভাব থাকার পরেও শোলের স্বাতন্ত্র্যতাকে অস্বীকার করা যায় না। সিনেমার বিজাতীয় স্থাপত্যের ভিতরে লুকানো রয়েছে অজস্র সূক্ষ্ম দেশি নকশা। রামগড় গ্রামটিই যেখানে একটুকরো ভারতবর্ষ, সেখানকার মানুষের জীবিকা, অর্থনীতি, উৎসব, বিপন্নতা কোনোকিছুই অপরিচিত নয়। যে গ্রামে সবথেকে সম্মানীয় ব্যক্তি দু-জন হলেন ঠাকুর বলদেব সিং এবং ইমাম সাহেব। মৃত সন্তানের সামনে বসে ইমাম সাহেব যখন বলে ওঠেন “আজ পুছুঙ্গা খুদা সে মুঝে অর দো চার বেটে কিউ নেহি দিয়ে ইস গাঁও পর শহীদ হোনেকে লিয়ে...” কিংবা ঠাকুরসাব যখন বলেন “ইয়ে দেশ যুগ যুগ সে কিষানো কা দেশ”, জয় ও রাধার অব্যক্ত প্রেম ভোররাতের হারমোনিকায় যখন মূর্ত হয়ে ওঠে, ইমার্জেন্সির সময় মুক্তি পাওয়া এই ছবিতে জয় রূপী অমিতাভ যখন বলেন “মুঝে তো হর পুলিশওয়ালো কে সুরত এক জ্যায়সি লগতি হ্যায়...” তখন ছবিটি প্রবলভাবে ‘দেশি’ হয়ে পড়ে। তখন আর শোলেকে বিজাতীয় মনে হয় না।
প্রজেক্টরের আলো পর্দায় গিয়ে পড়লে ছবি ফুটে ওঠে, সাথে সাথে দর্শকের সাথে সিনেমার যে রুপোলি সম্পর্ক তৈরি হয় সেই ম্যাজিককে আরও ঘনীভূত করেছিল রমেশ সিপ্পির শোলে। ৭০ মিমি স্ক্রিন ও স্টিরিয়োফোনিক সাউন্ড সেই প্রথম ব্যবহৃত হল ভারতবর্ষের কোনো চলচ্চিত্রে। গত পঞ্চাশ বছরে কত আলোচনাই হল শোলেকে নিয়ে, কিন্তু কীভাবে আমরা ভুলে গেলাম এই ছবির সিনেমাটোগ্রাফার দ্বারকা দিভেচার নাম? যিনি না থাকলে এইরকম আন্তর্জাতিক মানের দৃশ্যায়ন হয়তো সম্ভবই হত না। যিনি না থাকলে এই ছবির ভারী গল্প ও অনবদ্য সংলাপ হয়তো মাঠে মারা যেত। মুঘল-ই-আজম, গঙ্গা যমুনা, মেরে গাঁও মেরে দেশকে মনে রেখেই বলছি ভারতবর্ষের মাটিতে এর আগে কোনো বাণিজ্যিক ছবিতে এরকম অকল্পনীয় চিত্রগ্রহণ আমরা আর দেখেছি কি? ভারতীয় চলচ্চিত্রের ক্যানভাসকে এক লহমায় তুঙ্গে নিয়ে গেছে এই ছবির প্রযুক্তি। এই নির্মিতির কী নিদারুণ প্রভাব পড়তে পারে দর্শকের মনে তা স্মার্টফোনে এই ছবি দেখে বোঝা দু:সাধ্য। ভারতীয় সিনেমার দৃশ্য-শ্রাব্যতায় যে বিপ্লব নিয়ে এসেছিল শোলে সেটাই এর গ্রহণযোগ্যতায় অনুঘটকের কাজ করে। এই দেশের দর্শকের সিনেমা দেখার অভ্যাসে হ্যাঁচকা টান মেরেছিল এই ছবি। শোলে বদলে যায় মিথে। তৈরি হয় হিস্টিরিয়া। মাথা ঝুঁকিয়ে সিনেমা দেখার এই যুগে কল্পনা করতে এতটুকু কষ্ট হয় না যে মুঠোফোনের গব্বর সিংয়ের চাইতে সত্তর মিলিমিটার পর্দার গব্বর সিং অনেক বেশি বীভৎস। রাহুল দেব বর্মণের অবিশ্বাস্য ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর স্টিরিয়োফোনিকে আরও অনেক বেশি জীবন্ত। হেডফোনে এর স্বাদ পাওয়া অসম্ভব।
পাঁচ দশক পরে এই সম্ভ্রান্ত ছবিটির সামনে এসে দাঁড়ালে মনে হয় যে শোলে আসলে একটি সময়কে প্রতিনিধিত্ব করে। কমিউনিটি ভিউয়িংয়ের যে যূথবদ্ধ অক্ষরেখা ধরে বিস্তৃত হয়েছিল এর মহাকাব্যিক উন্মাদনা তা আজ বিলুপ্তপ্রায়। ব্যক্তিগত চাহিদার খাঁচায় নিরুপায় পাখা ঝাপটাচ্ছে বিনোদন। ভেঙে পড়া যৌথতার সামনে, দুমড়ে-মুচড়ে পড়া পুরানো প্রেক্ষাগৃহের সামনে এসে দাঁড়ালে মনে পড়ে শোলে ছবিরই একটি বিখ্যাত সংলাপ। বিষণ্ণ গোধূলিতে এ কে হাঙ্গল বলছেন “ইতনা সান্নাটা কিঁউ হ্যায় ভাই?” আজকের ডিজিটাল যুগের নীরবতা, বিচ্ছিন্নতা, ব্যক্তিকেন্দ্রিক আনন্দ সেই সান্নাটারই নামান্তর। আমাদের যৌথতার, সম্মিলিত বিস্ময়ের, একসাথে সিনেমা দেখার মহোৎসবের শেষ প্রহরের আর্তনাদ যেন এই সংলাপেই লুকিয়ে। আজকের কুক্ষিগত ডিজিটাল ফূর্তির মাঠে শোলে ছিল একসময়ের সদানন্দের মেলা।
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই,ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।


