preloader
বাংলা বইয়ের e-ভুবন
Menu Categories Search Cart 0
Menu
Cart

Total 0 Items

☹ Your cart is empty

Sub Total:

$0

₹0

বিভাগ
হল‍্যান্ডে হইচই: বাঙালির উৎসবে পূজাবার্ষিকী
ডায়াস্পোরা

হল‍্যান্ডে হইচই: বাঙালির উৎসবে পূজাবার্ষিকী

হল্যান্ডে এখন ছোটো-বড়ো মিলিয়ে প্রায় ১১টি পুজো হয়, তাদের মধ্যে অন্যতম পুজোর আয়োজক সংগঠনের নামটাও দারুণ মজাদার—‘হল্যান্ডে হইচই’। কেতাব-ই ডিজিটাল ডেস্কের তরফে আমরা কথা বলছিলাম ‘হল্যান্ডে হইচই’-এর অন্যতম সংগঠক সৈকত মিত্রের সাথে। সৈকত, শুধু পুজোর আয়োজনেই থেমে থাকেন না, স্ত্রী রুণার সঙ্গে যৌথভাবে হল্যান্ডে বাংলা বই এবং পুজাবার্ষিকী কলকাতা থেকে নিয়ে যাওয়ার কাজটিও করেন নিয়মিতভাবে। তাঁর সাথে কথোপকথনের মাধ‍্যমে আমরা ধরতে চাইলাম প্রবাসে বাঙালি যাপন আর উদ্‌যাপনের এক খণ্ডচিত্রকে।

শারদোৎসবই বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব কি না, এ নিয়ে তর্ক আছে, থাকবে। অংশগ্রহণের নিরিখে বিচার করলে ইদ অবশ্যই এগিয়ে থাকবে, তবে উৎসবের আবহ বিচার করলে অন্তত আজকের দিনে দাঁড়িয়ে শারদোৎসবকেই সর্বোচ্চ জায়গায় না রেখে উপায় নেই। আর এই শারদোৎসব কিন্তু নিছক দুর্গাপুজোই নয়, বরং সেই পুজোকে ঘিরে বিপুল সংখ্যক বাঙালির যে উৎসবে মেতে ওঠা, তার জৌলুস গোটা বিশ্বেই অনন্য। শারদোৎসবের জনপ্রিয়তার কারণগুলি যদি ফিরে দেখি, দেখব বারোয়ারি পুজো চালু হবার অনেক আগে থেকেই এই উৎসব বাঙালির প্রিয়, কারণ এই সময়ে আবহাওয়া ক্রমশ অনুকূল হয়ে উঠত, বর্ষার জল নেমে যেত অথচ নদীগুলি থাকত নাব্য, দূরদূরান্ত থেকে বাঙালি চাকুরীজীবিরা, ব্যাবসার কাজে বা অন্য কাজের জন্য যাওয়া প্রবাসীরা ফিরতেন ঘরে। শারদোৎসব তাই আদতে মিলনোৎসব।

এখন সময় বদলেছে, ঘরে ফেরার জন্য এখন আর জল নামার অপেক্ষা করতে হয় না—আবহাওয়াও পালটে ফেলেছে তার টাইম টেবিল। কিন্তু শারদীয়ার আনন্দ রয়ে গেছে অমলিন। এই সময়টা বাঙালির উৎসবে মেতে ওঠার সময়—স্কুল কলেজ, মায় অফিস আদালতও ছুটি। কিন্তু যাঁরা বাংলার বাইরে আছেন? এমনকি এই দেশেরও বাইরে আছেন? তাঁদের তো পুজোর ছুটি নেই। কিন্তু শারদোৎসব তো তাঁদেরও। তাই তাঁরা নিজেদের মতন করে গড়ে নেন উৎসবের আবহ। কেমন সে-আয়োজন? আমাদের থেকে কতটা আলাদা? সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কেতাব-ই কথা বলছে বিভিন্ন দেশের আয়োজকদের সাথে। আজকে আমরা চলে যাব সেই হান্স অ্যান্ডারসনের দেশে—হল্যান্ড, কিংবা যাকে অনেকে আবার বলি নেদারল্যান্ডস।

হল্যান্ডে এখন ছোটো-বড়ো মিলিয়ে প্রায় ১১টি পুজো হয়, তাদের মধ্যে রাজধানী আমস্টারডামের প্রথম এবং সে-দেশের দ্বিতীয় পুজোর আয়োজক সংগঠনের নামটাও দারুণ মজাদার—‘হল্যান্ডে হইচই’। আমরা কথা বলছিলাম হল্যান্ডে হইচই-এর অন্যতম সংগঠক সৈকত মিত্রের সাথে। তিনি শুধু পুজোর আয়োজনেই থেমে থাকেন না, স্ত্রী রুণার সঙ্গে যৌথভাবে হল্যান্ডে বাংলা বই এবং পুজাবার্ষিকী কলকাতা থেকে নিয়ে যাওয়ার কাজটিও করেন। পেশায় তথ্যপ্রযুক্তিকর্মী সৈকত বলছিলেন, অনেক আগে, ২০০৯ সালে লন্ডনে বেড়াতে গিয়ে তিনি দেখেছিলেন এরকমই এক বইপাগলকে, যিনি সেখানে বাংলা বই বিক্রি করছিলেন। সেখানে বিভিন্ন পূজাবার্ষিকীও রাখা ছিল। সদ্যতরুণ সৈকতের মনের মধ্যে সেই ছাপটা রয়ে গেছিল। পরে তিনিই নেদারল্যান্ডসে নিয়ে এলেন সেই একই সংস্কৃতিকে।

সৈকত এবং তাঁর স্ত্রী রুণা

হল্যান্ডে হইচই-এর সূচনা হয়েছিল ২০১৬ সালে। প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই আছেন সৈকত, যদিও তিনি নিজেকে ঠিক প্রতিষ্ঠাতা সদস্য বলতে রাজি নন, কারণ প্রথম দুয়েকটা মিটিঙে তিনি ছিলেন না। তা ছাড়া সেই অর্থে ওঁদের সদস্য বলেও কিছু হয় না, একটা কোর কমিটি থাকে, তবে যে কেউই চাইলে এই উৎসবে যোগ দিতে পারেন। কাজের দায়িত্ব নিতে চাইলে সেটাও পারেন। সবটাই স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে। ২০১৬-তে ওঁরা আয়োজন করেছিলেন একটা বিজয়া সম্মিলনীর। সেখানে খাওয়াদাওয়া, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সবই ছিল। সেই আয়োজন সাফল্যের সাথে করে ফেলার পর ওঁরা পরের বছর পয়লা বৈশাখ এবং দুর্গাপুজো আয়োজন নিয়ে ভাবা শুরু করেছিলেন। সেইমতো ২০১৭ থেকে শুরু হল পুজো। ঠাকুর আনানো হল কলকাতা থেকে। অফিস কাছারি স্কুল কলেজ সবই খোলা, অগত্যা সপ্তাহান্তই ভরসা। ওঁদের আয়োজন মোটামুটি পুজোর আগের বা পরের বা চলাকালীন শুক্র থেকে রবিবারের মধ্যে। এই বছরে যেমন ওঁদের পুজোর আয়োজন শুরু হয়েছে সেপ্টেম্বরের ২৮ তারিখ, শুক্রবার সন্ধে থেকে, আর চলবে সেপ্টেম্বরের ৩০ তারিখ, রবিবার রাত পর্যন্ত।

গতবছর হইচই-এর পুজোর সংগঠকরা

কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’

কী কী হয় সেই পুজোয়? বলা যেতে পারে, কী না হয়? শুক্র থেকে রবিবার, পাঁচ বেলার প্রতি বেলায় অন্তত সাড়ে তিনশো থেকে চারশো, কোনো কোনো সময়ে আরও বেশি মানুষ আসেন পুজো দেখতে, একসাথে বসে খেতে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখতে। খাওয়াটা শুধু আগে থেকে কুপন কাটতে হয়, এ ছাড়া আর সবই সকলের জন্য উন্মুক্ত। খাওয়ার মেনুতে বাঙালির প্রিয় যা কিছু, ইলিশ, চিংড়ি, মাটন, চিকেন, মোচার ঘন্ট থেকে মিষ্টি দই, পান্তুয়া, বাদ যায় না কিছুই। রান্না হয় অডিটোরিয়ামেই, হাতে গরম খেয়ে যান অতিথিরা। রান্নার দায়িত্ব স্থানীয় এক বাঙালি ক্যাটারারের, কাঁচামাল জোগাড় করে দেন উদ্যোক্তারাই। বাঙালিরা তো আসেনই, অনেক সময়ে আসেন তাঁদের স্কুল কলেজের ডাচ বন্ধুরাও। যাঁরা নিজেরা কোনো ডাচ-এর সাথে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ, তাঁদের পরিবারেরাও আসেন। আসেন ভারতের অন্যান্য রাজ্যের বাসিন্দারাও—এবারই যেমন উড়িষ্যার একটি সংস্থা সমবেত নৃত্য প্রদর্শন করছেন ওঁদের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে।

পুজোসংখ্যা বাঙালির শারদোৎসবের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কিন্তু বিদেশে এই পুজোসংখ্যা সময়মতো হাতে পাওয়া এক ঝকমারি। হল্যান্ডে এই ব‍্যাপারে দায়িত্ব নিতে এগিয়ে এসেছেন সৈকত আর রুণা। পুজোর অনেক আগেই ওঁরা মোটামুটি চাহিদা আন্দাজ করে বইয়ের অর্ডার দিয়ে দেন। তবে ওঁরা কোনো প্রি-বুকিং নেন না। পুরোটাই নিজেদের অনুভূতির উপর ভরসা করে অর্ডার করেন। পূজাবার্ষিকী যদি সব বিক্রি না হয়, তবে পরের বছর যাঁরা নতুন পূজাবার্ষিকী কেনেন, তাঁদের আগের বছরেরটি বিনামূল্যে উপহার দেওয়া হয়। পুজোর কাজ সামলে পুজোমণ্ডপে স্টল দেন সৈকত। উনি নিজেই স্টল সাব কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্তও বটে। এবছর যেমন অন্য কাজ সামলে শুধু শনিবারেই স্টল দিতে পারবেন ওঁরা। কিন্তু তারপরে আবার অন্য একটি পুজো কমিটি, যাঁরা দেশের পুজোর নির্ঘন্ট মেনেই পুজো করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আমস্টারডাম থেকে পঞ্চাশ কিমি দূরের লেনস্টাড শহরে, তাঁদের ওখানে নিজের বইয়ের স্টল নিয়ে দুইদিন বসবেন সৈকত।

হইচই-এর পুজোয় সৈকতের পূজাবার্ষিকীর স্টল

হল্যান্ডের মতো জায়গায় বইয়ের চাহিদা কীরকম, জানতে চাওয়া হয়েছিল সৈকতের কাছে। ওঁর মতে, ওঁর বয়সি বা ওঁর সিনিয়রদের মধ্যে বাংলা বইয়ের যথেষ্ট চাহিদা আছে—কিন্তু ওঁর পরের জেনারেশন, মানে এখন যারা কুড়ি থেকে ত্রিশের কোঠায়, নতুন নতুন চাকরি করতে বা ফেলোশিপ নিয়ে বা অন্য কাজে যাচ্ছেন, তাদের বড়ো অংশই বাংলা বই পড়ায় খুব একটা উৎসাহী বা স্বচ্ছন্দ, কোনোটাই নন। তাঁরা বই পড়েন না এমন নয়, কিন্তু মাধ্যম হিসাবে কিন্ডল বা ওইরকম কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইসই বেশি পছন্দ করেন, আর ভাষা হিসাবেও ইংরিজি গল্পের বইতেই তারা উৎসাহী—বাংলা নিয়ে অস্বস্তি আছে। আর ইয়ং জেনারেশন, যারা ওখানে স্কুলে কলেজে পড়ে, তারা ভালোবাসলেও উপায় নেই, কারণ স্কুলে বাংলা শেখানোই হয় না। বাড়িতে তারা অধিকাংশই বাংলা বলতে শেখে ঠিকই, কিন্তু লিখতে বা পড়তে সেভাবে শেখে না। ফলে বাংলা বই আর হিব্রু বইয়ে তাদের কাছে বিশেষ ফারাক থাকে না।

হল্যান্ডে হইচই-এর পুজোয় এবারে নতুন ঠাকুর আসছে। ২০১৭ সালের পুজোর সময়ে যে ঠাকুরটি এসেছিল, এতদিন সেটিই রাখা থাকত ওয়ারহাউসে, পুজোর অন্যান্য উপচার এবং সরঞ্জাম সহ, পুজোর সময়ে তাকে বের করে ঝকঝকে করে তোলা হত। এবার নবম বছরে আসছে নতুন পাঁচচালার ঠাকুর—শিল্পী কুমোরটুলির প্রদীপ রুদ্রপাল। আগের ঠাকুরটি এবার চলে যাচ্ছে জার্মানির হামবুর্গের এক নতুন পুজো কমিটির কাছে। হল্যান্ডে হইচই-এর তরফ থেকে এই ঠাকুরটি তাদের উপহার হিসাবে দেওয়া হচ্ছে, পারস্পরিক সৌহার্দ্যের কথা মাথায় রেখে। এখানে আগামী অন্তত বছর পাঁচেক আবার এই ঠাকুরের প্রতিমাই থাকবে।

এবছর ওঁদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসছেন বিশিষ্ট গায়ক ঋষি পান্ডা। ২০১৯-এ এসেছিলেন অঞ্জন দত্ত। এ ছাড়া জুবিন গর্গ, অমিত সানা প্রমূখ অনেক শিল্পীই ওদের মঞ্চে গান শুনিয়ে গেছেন। আর অতিথি শিল্পীরা ছাড়াও পুজোয় থাকে ওঁদের নিজেদের অনুষ্ঠান—বড়োদের এবং ছোটোদের নাচের অনুষ্ঠান, নাটক, গান, আবৃত্তি ইত্যাদি। সবটাই মূলত বাংলায়। ছোটোরা এই তিনটে দিন দারুণ উপভোগ করে, জানালেন সৈকত। তাদের বাবা-মায়েরাও এই উৎসবকে ঘিরে কীভাবে মেতে ওঠেন, তা ওরা দেখে—ফলে পুজোর সেই ফ্লেভার পশ্চিমবঙ্গে কখনও না থেকেও ওরা কিছুটা হলেও বুঝতে পারে। এভাবেই ওরা নিজেদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে মনে রাখার রসদ পায়। দুর্গাপুজো ছাড়াও হল্যান্ডে হইচই প্রতি বছর পয়লা বৈশাখ এবং সরস্বতী পুজোরও আয়োজন করেন। পয়লা বৈশাখ এক সন্ধের অনুষ্ঠান, কিন্তু সেখানেও থাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সরস্বতী পুজোয় অবশ্য শুধু পুজো, অঞ্জলি, এসবের ওপরেই জোর দেওয়া হয়, তবে ছুটির আনন্দটুকু থেকেই যায়। পরবর্তীকালে দ্বিতীয় প্রজন্ম কতটা এই ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাবে তা ভবিষ্যতই বলবে, কিন্তু এখন অন্তত ওরা খুবই আনন্দে থাকে এইসব উৎসবের সময়গুলোতে, এতে সন্দেহ নেই।

খুব বড়ো আয়োজন কিছু নয়, কলকাতার বড়ো বড়ো পুজো কমিটিদের কাছে হয়তো নেহাতই চুনোপুঁটি, কিন্তু আন্তরিকতায় আর উৎসাহে কারুর থেকে ওঁরা কম যান না। নিজেদের ভালোলাগাটুকু ভাগ করে নেবার যে আনন্দ, সেই আনন্দেই ওঁরা এগিয়ে চলেছেন। কিন্তু শুধু কী সেটুকুই? আজকের আত্মবিস্মৃতির যুগে যখন সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক—সবদিক থেকেই বাঙালি নানাভাবে কোণঠাসা, সেখানে লাভ লোকসানের পরোয়া না করে ‘বাংলা পূজাবার্ষিকী’ নামের একটা আপাততুচ্ছ নস্টালজিয়াকে বাঁচিয়ে রাখার এই উদ‍্যমকে কী বলা হবে? ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো? নাকি ‘যে যেখানে লড়ে যায় আমাদেরই লড়া’? বিচারের ভার রইল পাঠকের হাতেই।


কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই,ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন


এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।

মন্তব্য করুন