জীবন, মাটি, শস্য, জন্ম, নাভি, স্মৃতি আর রক্তের আদিম সুরে গঠিত এই কবিতাগুচ্ছ পাঠককে টেনে নেয় অস্তিত্বের গভীর প্রকোষ্ঠে। পলি, ঘোড়া, ধোঁয়া, নদী, ঘুড়ি ও রোববারের বাজার—সব মিলিয়ে গড়ে ওঠে এক দহনসুন্দর বাস্তব ও মিথের কবিতাভুবন।
১
এই খুচরো জীবনের পাশে চিরকাল
চাঁদ থেকে যাবে। দক্ষিণে উঠবে, উত্তরে ঈষৎ বেঁকে
দালানে পাঁজরখানি খুলে রেখে যাবে।
খুব ভোরে জল খেতে উঠে তুমি দেখবে
সমস্ত উঠোন জোৎস্নায় কাঠ হয়ে আছে…
যেন কেউ এই খুচরো জীবনকে
বেটে রেখে যাবে শিলনোড়ায়।
ভোর আসছে। সন্ধে ভেবে ডেকে উঠল কাক।
কচি দুটো হাত স্বপ্নে দেখছে
চিমনির গাঢ় ধোঁয়ায় মা ঢেকে যাচ্ছে,
পুড়ছে ইট, লোথাল বন্দর।
শুধু ওই হাতের তালুতে রয়ে গেছে
মায়ের অশরীরী কাঠামো।
২
সম্পূর্ণ হয়েছে বীজ নিরক্ষরেখায়।
হা শস্য হা মাটি হা উদ্ভিদ…
আর ভাত? সেও তো শস্যপ্রায় ডাকে
ভুলে গেছে এইবার তাকে ধুলো দিতে হবে।
প্রতিমার শূন্য অবয়ব ভেবে পলিমাটি
তুলে নেবে শিল্পী।
তারপর লোহাচুর মিশে আরও উর্বর হলে
আরও রসা আরও লাস্য হলে,
পিতামহকে বলব, এইবার আপনি
ভিটে ছেড়ে চলে যান।
ততক্ষণে ধমনীতে নবান্নের ছায়া
বহুদূর গ্রাম থেকে শহরতলিতে ছড়িয়ে পড়েছে।
পিয়োনের অবলুপ্ত চিঠি তার হাত ধরে নিয়ে যায়—
আকরিক লোহার ভেতর, জড়জীবনের প্রাণ
বা… বলে ডেকে ওঠে। যেন
ভাতের জঠর থেকে ফ্যান গেয়ে গেয়ে উঠছে
হা প্রসূতি হা পিপাসা
কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
৩
এই সেই পলি, যার কোলে মুখ রেখে
আস্তাবল খুঁজেছিল চড়ুই।
ঘোড়ার খুরের শব্দে ভরে গিয়েছিল জন্মস্থান,
তারপর চেনা রূপ সরে যেতে
সদ্য জেগে ওঠা গোলাপি মাংসের আভায়
সূর্যোদয় হল। ঘোড়াটির চোখ কানা
তাই এতদূর সমুদ্র পেরোনোর পরেও
সে একফোঁটা লবণ দেখেনি।
শুধু বারবার লোহাচুর ঝরে পড়ছিল
কোনো হাইওয়ের ধারে
কেটে নেওয়া গাছের যকৃতে।
ধূপ বিক্রি করে বেড়াচ্ছিল কোনো
নিরক্ষর ছেলে। আর সেই সুগন্ধের টানে
শিখেছিল রক্তের মর্মার্থ।
কীভাবে সমুদ্র জমে নাভি হয়,
নাভি জমে গাছ,
গাছের কোটরে জমে থাকা জলে
পোকার জীবন গড়ে ওঠে।
৪
হাপ্তা ফেলে ফেলে উড়ে যাচ্ছে ঘুড়ি,
উত্তর-পশ্চিম পাড়া থেকে বারুইপাড়ার দিকে।
ঘুড়ির পেছনে ছোটা উদোম ছেলের
পায়ের তলায় চলমান খানখান মাটি…
পৃথিবীর আবর্তন হচ্ছে।
এই যে বাড়িটা সামনে ছিল, সেও এখন পেছনে।
এইমাত্র যে বৃদ্ধটি আমার শৈশব ভেবে
মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন, তিনিও এখন
দূর ফুটকির মতো অসহায়।
তালকানা ঘুড়িটা গোলাপি সুতো নিয়ে
নেমে এল চঞ্চল মাটিতে।
অথচ কখন সে মৃত, আকাশেই।
নাছোড় পৃথিবীই তাকে
বালকের আকাঙ্ক্ষায়
এইভাবে বাঁচিয়ে রেখেছে।
৫
রোববারের বাজার।
ছাড়ানো মুরগি শুইয়ে রাখা পাশাপাশি।
তাদের কাঁপাকাঁপা গোলাপি ত্বকে
রক্ত মাখিয়ে দিচ্ছে যে লোহার থাবা
তার আঙুল জড়িয়ে ছেলে স্কুলে যায় রোজ।
‘ছোটো দেখে মারো’—বলে ওঠে সুঅভিজ্ঞ ক্রেতা।
নাড়িভুঁড়ি, লিভার, অন্ত্র, তারপর
বডি আর লেগে চিরে যাওয়া বিভক্ত পৃথিবী
মাঝারি ও ছোটো মাপে ভাগ হয়ে হয়ে
কালো পলিথিনে ঢুকে গেল দ্রুত।
বাড়ির ফেরার পর মনে হল,
আহা এই টাটকা মাংসের স্বাদ!
সুখের অনন্ত হবে প্রেসার কুকারে…
পেঁয়াজ, রসুন আর গোলমরিচের গন্ধে
মুরগির গোলাপি ত্বকে অভিমান লুপ্ত হয়।
রোববারের দুপুরে, অপরাধী লোহার থাবা
ছেলের ঘুমন্ত বুকে, পাখির হৃৎপিণ্ড পেয়ে
চমকে চমকে কেঁদে ওঠে রাশভারী স্বপ্নের ভেতর।
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই,ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।