সন্ধে হয়ে এলে পিকাসোর চোখে পড়ল পূর্ণিমার লাল চাঁদ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে মেঘ কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে জলরংয়ের মতো। আকাশে তারা নেই। কারণ আজ চৌঠা আষাঢ়, হয়তো বৃষ্টি নামবে। রাত্রে আবার একবার স্নান করতে গিয়ে শাওয়ারের ট্যাপ খোলে পিকাসো, কিছুটা জল গায়ে পড়ে। প্রায় হঠাৎই পিকাসোর মনে পড়ে ছাদ আর জুঁইয়ের কথা।
একটা গাছ কীভাবে বেঁচে থাকে! জল-হাওয়া-মাটি-উষ্ণতা-শীতলতা—অনেকরকমভাবেই। কিন্তু পিকাসো ওর ছাদবাগানের জুঁই গাছটাকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছে মিউজিকের মাধ্যমে। শুনে হয়তো একটু অবাকই হতে হয়, কিন্তু পিকাসো আর জুঁইয়ের জীবনে এটাই সত্যি। সত্যির রকমফের থাকে না, সে চিরন্তন, অনন্ত। সত্যির একটা জোর থাকে। জুঁইয়েরও একটা জোর আছে, পিকাসোর ওপর। জুঁই জানে, আজ যদি সে অস্ট্রেলেশিয়া বা ইউরেশিয়ায় থাকত, ওকে তাহলে দুষ্প্রাপ্য ভেবে যত্ন করা হত। অথচ পিকাসোর পাড়াগাঁয়ে লোকে শুধু বুঝল নয়নতারা, আকন্দ, শিউলি, গোলাপ, জবা আর নিদেনপক্ষে লিলিকে। জুঁই কেমন যেন ব্রাত্য! অথচ তার ভুবনজোড়া গন্ধ। জুঁইয়ের রাগ হয়, কিছুটা মনকেমনও করে। তিউনিসিয়ার জাতীয় ফুল হয়েও বাংলার মাঠ ঘাট প্রান্তরে জুঁইয়ের তেমন সমাদর নেই ভেবে আজ চৌঠা আষাঢ় জুঁইয়ের খুব মনখারাপ।
পিকাসো গান ভালোবাসে। চমৎকার গানও গায়। গত এক সপ্তাহ গানের অনুষ্ঠানে বাড়ির বাইরে থাকায় ছাদবাগানে একা ঠাঁই কেমন সহায়সম্বলহীন একফালি টবে দাঁড়িয়ে থাকা জুঁইয়ের খবর নেওয়া হয়নি। পাতা এল? ফুল এল? মাটি শুকিয়ে চৌচির। তবু বাড়ি ফিরে পিকাসোর একবারটিও মনে পড়ল না প্রিয় গাছটার কথা। পিকাসো খেল। পিকাসো স্নান করল। পিকাসো গিটার নিয়ে বসল। পিকাসো মাস্টারবেট করল পরপর দুইবার। চারপাশ সন্ধে হয়ে এলে পিকাসোর চোখে পড়ল পূর্ণিমার লাল চাঁদ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে মেঘ কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে জলরংয়ের মতো। আকাশে তারা নেই। কারণ আজ চৌঠা আষাঢ়, হয়তো বৃষ্টি নামবে। রাত্রে আবার একবার স্নান করতে গিয়ে শাওয়ারের ট্যাপ খোলে পিকাসো, কিছুটা জল গায়ে পড়ে। প্রায় হঠাৎই পিকাসোর মনে পড়ে ছাদ আর জুঁইয়ের কথা। পিকাসো ছাদে যায়।
নিস্তরঙ্গ গাছটাকে দেখে পিকাসোর কান্না পায় খুব। কিন্তু কাঁদে না। আকাশের দিকে তাকাতেই ওর চোখে পড়ে ওই একইরকমভাবে ঘোলাটে চাঁদ বিরাজমান। হয়তো বৃষ্টি হবে খুব। বর্ষার প্রথম বৃষ্টি। পিকাসো ভিজবে। জুঁই ভিজবে। ছাদ ভিজবে। ভিজতে ভিজতে একদিন পিকাসো রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনবে টুকরো টুকরো গান। শহরের রাস্তা কোরাস গাইবে। বৃষ্টির সমস্ত নুড়িপাথরগুলো একসঙ্গে হারমনি করবে। আর জুঁইয়ের মাটি ভিজবে। আকাশছেঁচা বৃষ্টি হবে খুব। পিকাসো তৎক্ষণাৎ জুঁইয়ের কাছে যায়, ছোঁয়, হলুদ পাতা তুলে দেয়, কুঁড়িগুলোর দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থাকে, তারপর স্নান করায়। পাতা থেকে মুছে দেয় জমে থাকা ধুলো। দু-একটা ফুল যা ফুটে আছে, ওদের দিকে চেয়ে মুচকি হাসে। তারপর কিছুক্ষণ মেঘ গুড়গুড়, কিছুক্ষণ বিদ্যুতের তীব্র ঝলক, তারপর অঝোরে...
কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
রিকুইয়েম। ডি-মাইনর। মোৎজার্টের সর্বশেষ সৃষ্টি। কী তার অর্থ? মৃত ব্যক্তির আত্মার শান্তি কামনায় প্রার্থনা। এ-কাজ মোৎজার্ট শেষ করে যেতে পারেননি। এই রিকুইয়েম একদিন ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবী জুড়ে। সংগীতের নতুন মূর্ছনা তৈরি করে। এ মহাবিশ্বের আদি ও অনন্তের যে রহস্যজনক অন্ধকার, তার হৃদয়বিদীর্ণ করে বেরিয়ে আসে আদি ও অকৃত্রিম মোৎজার্টের হারমনি। মোৎজার্ট জানতেন তাঁর মৃত্যু আসন্ন। জুঁইয়ের মৃত্যুও কি আসন্ন? মানুষের মৃত্যুতে মানুষের চোখে জল আসে। অথচ জুঁইয়ের মতো সামান্য গাছ যদি ধীরে ধীরে শুকিয়ে পাতা শুকোতে শুকোতে একদিন রূপহীন গন্ধহীন হয়ে যায়, মানুষ কি তখন আদৌ কাঁদে? পিকাসো এবার কাঁদে।
দুঃখিত জুঁই! দ্যাখো আজ আকাশে কালো মেঘ। কতদিন পর শহরে বৃষ্টি হচ্ছে। আষাঢ়ে বৃষ্টি। আজ আমরা ভিজছি। দুজনে। একা। জুঁই, তুমি ভালো হয়ে যাও। তোমার গন্ধে আমি প্রেমে পড়ি বারবার। জুঁই, তীব্র হও। আরও আরও তীব্র। পাগল হয়ে ওঠো। গান শুনবে জুঁই?
রিকুইয়েম। ডি-মাইনর। মোৎজার্ট। সিম্ফনি ক্রমশ উচ্চাঙ্গে উঠছে আর নামছে। সে এক মহাসন্ধিক্ষণ। চৌঠা আষাঢ়। তুমুল বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে দিগ্বিদিক। আর মোৎজার্টের সুর একবার হাওয়ায় ধাক্কা খাচ্ছে, আবার বৃষ্টির তালে তালে স্বর উঠছে তীব্রতায়। কখনও কোরাস, কখনও একক। মোৎজার্ট শুনে গাছ বাড়ছে। জুঁই নিশ্বাস নিচ্ছে সংগীতের তুমুল মূর্ছনায়। আমরা অবাক হতে ভুলে যাচ্ছি আজকাল। পিকাসোও ভুলে গিয়েছিল। এইবার পিকাসো আর জুঁই একসঙ্গে, একা, মুখোমুখি, অবাক হচ্ছে। নেতিয়ে যাওয়া পাতা চাঙ্গা হয়ে উঠছে। জুঁইয়ের মন ভালো হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ, শিরদাঁড়া টানটান হচ্ছে। একটু সুর, একটু বৃষ্টি, একটু মোৎজার্ট—আকাশে আর চাঁদ নেই। শুধু জুঁই আর পিকাসো। মোৎজার্ট জুঁইকে অবিশ্বাস্যভাবে বাঁচিয়ে দেয়।
ওইদিন থেকে প্রতি চৌঠা আষাঢ় শহরজুড়ে বৃষ্টি নামে। প্রতি বাড়িতে চলে মোৎজার্ট। সন্ধেয় যে যার মতো গাছে সামান্য জল দেয়। পিকাসোরা মরে গেলেও জুঁইয়েরা বেঁচে থাকে।
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই,ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
মন্তব্য করুন