আশ্বিন মাসটার শুরু থেকেই প্রচণ্ড গরম। শুধু তো আকাশ বাতাস গরম নয়। রাস্তা গরম, জীবিকাহীন যুবক যুবতীর মাথা গরম, আলুতে গরম, পেঁয়াজে গরম, সরষের তেলে গরম, ইলিশে গরম, টিভি চ্যানেলগুলো গরম, ডিএ নিয়ে গরম, অব্যবস্থা নিয়ে গরম, হত্যা আর ষড়যন্ত্র নিয়ে গরম, আলোর বিপরীতে থাকা মানুষগুলো আজ গরম। এসির স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে শহরের ফর্সা ফর্সা সুন্দর মানুষগুলো আজ রাস্তায় নেমে এসেছেন। এতদিন ধরে মানুষের শরীরের ভেতরের রাগ জমে জমে গরম হয়ে আছে। বৃষ্টি যেন নৌটঙ্কি করতে আসছে। এসেই চলে যাচ্ছে। মাটির ভেতরের গরমকে জাগিয়ে দিয়ে জনজীবনকে আরও অসহায় করে চলে যাচ্ছে। অন্তত একটা ঝড় আসুক। মুষলধারে বৃষ্টি আসুক। জনজীবন বিপর্যস্ত করা প্রলয় আসুক।
আশ্বিন মাসটার শুরু থেকেই প্রচণ্ড গরম। শুধু তো আকাশ বাতাস গরম নয়। রাস্তা গরম, জীবিকাহীন যুবক যুবতীর মাথা গরম, আলুতে গরম, পেঁয়াজে গরম, সরষের তেলে গরম, ইলিশে গরম, টিভি চ্যানেলগুলো গরম, ডিএ নিয়ে গরম, অব্যবস্থা নিয়ে গরম, হত্যা আর ষড়যন্ত্র নিয়ে গরম, আলোর বিপরীতে থাকা মানুষগুলো আজ গরম। এসির স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে শহরের ফর্সা ফর্সা সুন্দর মানুষগুলো আজ রাস্তায় নেমে এসেছেন। এতদিন ধরে মানুষের শরীরের ভেতরের রাগ জমে জমে গরম হয়ে আছে। বৃষ্টি যেন নৌটঙ্কি করতে আসছে। এসেই চলে যাচ্ছে। মাটির ভেতরের গরমকে জাগিয়ে দিয়ে জনজীবনকে আরও অসহায় করে চলে যাচ্ছে। অন্তত একটা ঝড় আসুক। মুষলধারে বৃষ্টি আসুক। জনজীবন বিপর্যস্ত করা প্রলয় আসুক। বিশ্বাস করাতে পারব কি না জানি না এক বেসামাল অস্বস্তিতে দিন পনেরো ধরে আবাসনের ষোলো-শো স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে বসে বসে আর সময় কাটছে না। একেবারেই বসা। এইমাসে আমার তিন-তিনটে হেভি বুকিং ক্যান্সেল হয়েছে শুধুমাত্র সামাজিক অস্থিরতার কারণে। তিনটেই কলকাতার বুকিং। ডামাডোলের বাজারে কেউ ঝুঁকি নিতে চায়নি। এখন একটা অস্থির সময় তৈরি হয়েছে। রাস্তায় মুখ দেখানোটা অত্যধিক প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে অনেক মানুষের। রাস্তায় এসে দাঁড়ালে কত পুরোনো মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে যাচ্ছে। ফ্ল্যাটে বসে যা এতদিনে সম্ভব হয়নি। কিছু স্বাবলম্বী মানুষ চাইছে আনন্দের এদিক-সেদিক ব্যাপারগুলো বন্ধ রাখতে আপাতত। একটা জনউৎকন্ঠা তৈরি হয়েছে বলেই হাত ধরে ধরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ছে প্রতিবাদ করার জন্য। সবাই নিজের রং লুকিয়ে রেখেছে। সবাই বলছে আমরা দলহীন অদলীয়। দলবাজির প্রতি কতটা ঘৃণা থাকলে মানুষ এভাবে রুখে দাঁড়াতে পারে।
কাউকে বোঝাতে পারছি না। বাস্তবিক সেটা বোঝানো সম্ভবও নয়। আমার প্রফেশানের জন্য সামাজিক বিশৃঙ্খলাহীন একটা সুন্দর পরিবেশ চাই। সঙ্গে সুন্দর আকাশ, পরিচ্ছন্ন বাতাস, সুশৃঙ্খল রাজপথ আর জীবিকায় সফল কয়েকজন উদার অভিযাত্রী। সেখানে অবশ্যই মাঝে মাঝে মৃদু বৃষ্টিপাতও চলতে পারে। থাকতে পারে আকাশের তড়িৎ হানায় আপ্লুত একটা সুন্দর মন যার বেঁচে থাকার অদম্য স্পৃহা। পৃথিবীর রূপ রস গন্ধের প্রতি আসক্তি। স্বাবলম্বী এবং কর্মঠ মানুষ হয়েও লাজুক একটি মনের পালনকারী হবেন তিনি। সবসময় যেমন চাহিদা থাকে সেরকম বুকিং পাওয়া যায় না। ভাস্কর খুবই কো-অপারেট এবং উন্নত মেধার মানুষ। বুকিং নেওয়ার সময় অনেকটা গেজ করতে পারেন। সার্ভিসের আগে কিছু প্রয়োজনীয় টিপস দিয়ে থাকেন। খুব কাজে লাগে। তিন নম্বর বুকিংটা ক্যানসেল হবার পর ভাস্কর ফোন করে বলল, ম্যাডাম আপনার লাস্ট বুকিংটাও ক্যানসেল করে দিতে বাধ্য হলাম। আপনি চাইলে আবার বুকিং-এর অপশন আছে। কী করব? ভাস্কর যখন ক্যানসেল করেছে ফ্যাক্টস আছেই। বলে দিলাম, ঠিক আছে ভাস্কর, ছেড়ে দাও। তারপর থেকে পুরোপুরি বসা।
আমার প্রফেশনে একটানা বসে থাকার রেজাল্ট হল কেরিয়ারটা শ্লথ হয়ে যাওয়া। যতক্ষণ বসে থাকা হবে স্পিডটা ধীরে ধীরে কমতে থাকবে। অনেকটা ঝাঁ-চকচকে লেটেস্ট মডেলের গাড়ির মতো। গাড়িগুলো রাস্তা দিয়ে ছুটে গেলে আমি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকি। কতরকম কোম্পানির কতরকম মডেল। যেকোনো নতুন গাড়ির কত যত্ন ঝাড়া মোছা শিশিরের হাত থেকে বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করতে মালিক ঢেকে রাখেন। ঠিক যেভাবে ক্লান্তি আর বয়সকে আমরা প্রসাধন দিয়ে ঢেকে রাখি। একটি নতুন গাড়ি পনেরো থেকে কুড়ি বছর পর স্পিড হারিয়ে খর্ব হয়ে যায়। বিক্রি হয়ে অন্য মালিকের হেফাজতে চলে যায়। নতুন মালিক তখন সওয়ারিগাড়ি হলে পাবলিক রুটে নামিয়ে দেবে। পণ্য পরিবহনের গাড়ি হলে আবর্জনা বহন করাবে। এইভাবে যতদিন কালোয়াতের হাতে না দিয়ে পারে ততদিন লজঝড় গাড়িটাকে খাটাবে। সেইসব ক্ষয়ে যাওয়া বসে যাওয়া ধুঁকে ধুঁকে চলা গাড়ির দিকে তাকালে আমার সারা শরীরটা আতঙ্কে আহত হয়ে ওঠে। আমি পারতপক্ষে কোনো পুরোনো বসে যাওয়া গাড়ির দিকে তাকাই না। কালোয়াতের ঘরের পাশ দিয়ে কোনো কারণে আসা-যাওয়া করলে ভুলেও ওদের বাতিল, ভেঙে ফেলবে এমন গাড়িগুলোর দিকে তাকাই না। আমার ভীষণ আতঙ্ক হয়। ভয় হয়। যাত্রী পরিবহনে লজঝর বাসের দিকে তাকালে আমি বিমর্ষ হয়ে পড়ি। ঠিক এমনি একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমাদের সোনারতরী আবাসনের এবারের দুর্গাপূজার মিটিংয়ে যাওয়ার পথে।
সোনারতরীর এফ ওয়ান ব্লকটা আবাসনের মাঝামাঝি জায়গায়। এই ব্লকেই সোনারতরী আবাসনের জিম আর ক্লাব। ক্লাবঘরে বিভিন্ন রকমের ইনডোর গেমসের অ্যারেঞ্জমেন্ট আছে। আমার সেভাবে ক্লাবে যাওয়া হয় না। তা সত্ত্বেও বছরে দু-বার ওখানে যেতেই হয়। প্রথমত, বাংলা নতুন বছর, দ্বিতীয়ত, শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে কয়েকবার। এবারের দুর্গাপূজার মিটিংটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিছু আবাসিক বলছেন প্রতিবছরের মতো এবারেও সব পরিবার মিলে একসঙ্গে পুজোর কয়েকটা দিন আনন্দ হইহুল্লোড় দেদার খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। অংশত কিছু আবাসিকরা সেটা চাইছেন না। তাঁরা মনে করছেন একটা দগদগে সামাজিক যন্ত্রণা নিয়ে, কাজের ক্ষেত্রে মেয়েদের নিরাপত্তার প্রশ্নে, জাঁকজমক বাদ দিয়ে নির্লিপ্ত পুজো হোক। এটা নিয়েই জরুরি মিটিং ডেকেছেন আবাসনের সেক্রেটারি। আমি এই মিটিংটাতে থাকাটা খুব জরুরি মনে করেছি।
আমি এই আবাসনের ডি-ব্লকে থাকি। ফলে এফ ব্লকে যেতে হলে পেছন দিকের সুদৃশ্য রাস্তা ধরে বাঁ-দিক বরাবর কিছুটা হেঁটে যেতে হয়। এই রাস্তায় কিছুটা দূরত্ব নিয়ে দুটো ছাতিম গাছ আছে। আবাসন থেকে সকলে মিলে গাছদুটোর বিস্তারিত শিকড়কে ঘিরে বসার জায়গা করে দিয়েছেন। অনেকদিন পর এই পেছন দিকটায় হাঁটতে হাঁটতে এসে দেখলাম ছাতিমগাছদুটো ফুল ছেড়েছে। বাতাসে গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। ছাতিমগাছ ছাড়িয়ে কিছুটা এগিয়ে ক্লাবের দিকে ঢুকতেই ডানদিকে আবাসনের কমন গ্যারাজ। দেখলাম গ্যারেজে এই সময় কোনো গাড়ি নেই। একটা মাত্র পুরোনো ইনোভা গাড়ি রাখা আছে। গাড়িটার ব্ল্যাকিস রংটা চটে গেছে। কৌতূহলে গ্যারাজের ভেতরে ঢুকে গেলাম। দেখলাম ভেতরের সিট থেকে কেবিন পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে। এঞ্জিনে স্পষ্ট জঙের দাগ। বিক্রি করে দেবার অবস্থায়ও নেই। এখন কোনো কালোয়াতের নজরে পড়ার অপেক্ষায় আছে। দরদামে পোষালে ভেঙে-চুরে নিয়ে যাবে। হায়রে ইনোভা গাড়ি। দেখতে দেখতে আমার সারাশরীরে একটা ভয়ংকর কাঁপুনি আর ভীতি ছড়িয়ে পড়ল। অপাংক্তেয় অবস্থায় পড়ে থেকে নীরব হয়ে যাওয়া এই যন্ত্রচলকটি আমার শরীরের ভেতরটাকে যন্ত্রণায় মুষড়ে দিল। ইনোভা গাড়িটা আমাকে যৌবনের গল্প শুনিয়ে চলেছে একের পর এক। আমি নিবিষ্ট শ্রোতা হয়ে এই ইনোভা গাড়িটার কথা শুনে যাচ্ছি। সহমর্মিতা অনুভব করছি।
চমকে উঠলাম আবাসনের সেক্রেটারি অবসরপ্রাপ্ত ইনকাম ট্যাক্স অফিসার জয়ন্ত বোসের ঘোষণায়। এবার আমরা আমাদের সোনারতরী আবাসনের ডি ব্লকের আবাসিক কনসালটেন্ট থেরাপিস্ট শ্রীমতী অনুশীলা চ্যাটার্জিকে তাঁর মতামত জানাতে অনুরোধ করছি। ঘোষণার শব্দে চমকে উঠলেও সামান্য সময়ের মধ্যে নিজেকে গুছিয়ে প্রতিবাদটা জানালাম। বললাম, এখনও যদি আমরা কোনো পরিকল্পিত জঘন্য হত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, দোষীদের শাস্তির দাবিতে আনন্দ উৎসবকে দূরে সরিয়ে রাখতে না পারি একজন মানুষ হিসেবে নিজেদের ভাবতে পারব কি? আমার মনে হয় আবাসনের এই বছরের পুজোটা, জৌলুস বাদ দিয়ে করা হোক। মাত্র কয়েকজন আমার আবেদনটা অনুমোদন করল, বাকিরা একেবারে চুপ।
প্রায় দিন দশ-বারো একদম বসা। একের পর এক বুকিং ক্যানসেল। মিটিঙে যতটুকু সময় কাটল তারপর ফ্ল্যাটে ঢুকে একদমই সময় না-কাটার অবস্থা। বসে থাকলে কোনো চ্যানেলেই খবর দেখা বা শোনা যায় না। পুরোটাই অতিরঞ্জিত মনে হয়। ঘরে বসা থাকলে যা হয়। পমকে অনেকটা সময় দেওয়া যায়। পমকে সময় দেওয়া মানে হাজার একটা বায়না। মৃদু তিরস্কার করলেও মেয়ের বায়না শুনতেও ভালো লাগে। ভালো কলেজে চান্স পেয়েছে ওর মেরিটের জোরেই। কলেজ থেকে ফেরার পথে বন্ধুদের কাছে শুনেছে সাউথসিটি মলে কিছু সিলেক্টেড ওয়্যার এসেছে যা কিনা খুবই লেটেস্ট এবং মর্ডান ফ্যাশান ওরিয়েন্টটেড। মারাত্মক বায়না। নিয়ে যেতেই হবে। আমার মনটাও ঘরে বসে থেকে থেকে বোর হচ্ছিল। বেরোতে চাইছিল। আবদারের কারণে মা মেয়ে সকাল সকালই বেরিয়েছিলাম। মলে একবার ঢুকলে কখনো বাজেট ধরে রাখা যায় না। প্রায় তিন ঘন্টা লাগল পমের চয়েজ মিলিয়ে কেনাকাটা শেষ করতে। এরপর মা এবং মেয়ের কিছু ইনার গার্মেন্টস চয়েজ করলাম। এদিক-সেদিক একটু ঘোরাঘুরি করলাম। এভাবেই দিনটা শেষ করে রাত এল। কেনাকাটা ব্রেকফাস্ট লাঞ্চ ডিনার ওলা বুকিং নিয়ে প্রায় কুড়ি হাজার টাকা খরচ হল। টাকার অঙ্কটা মনের মধ্যে খচখচ করলেও একটা ভালোলাগার অনুভূতিও আমাকে সারাদিন ঘিরে ছিল। ইনকাম করি তো খরচ করার জন্যই। মেয়ের জন্য খরচ করেছি ভেবেই ভালো লাগছে। রাতে ফিরছি, আবাসনের কাছাকাছি ওলা আসতেই দেখলাম প্রচুর মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানব-শৃঙ্খল তৈরি করে প্রতিবাদে নেমেছে। পম বায়না করল রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করবে। বললাম, ফ্ল্যাটে প্যাকেটগুলো রেখে এসে ঝাড়া হাত-পায়ে আমিও দাঁড়াব চল। পম রাজি হল। আবাসনের মুখে ওলাটা ছেড়ে দিলাম। কী যে ভালো লাগছিল সারাদিনের ক্লান্তির পর প্রতিবাদে রাস্তায় দাঁড়াতে। কত মানুষ। এদের অনেকেই আমাদের আবাসনের প্রতিবেশী। এতদিন মুখ চেনা ছিল। আজকে পরস্পর পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হলাম। আমি প্রাণভরে মানুষের যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশগুলো দেখার এবং বোঝার চেষ্টা করছি। রাত প্রায় ন-টা হবে তখন। ভাস্করের ফোন। কিছুটা অবাক হলাম সময়ের কথা ভেবে। মানুষের চিৎকার থেকে একটু আড়ালে গিয়ে রিসিভ করলাম, কী ব্যাপার ভাস্কর?
ম্যাডাম, একটা বুকিং ছিল, মুম্বাইর কম্পানি, রাতেই এপোয়েন্টমেন্ট! বুক করব?
সামান্য সময় ভেবে নিয়ে বললাম, আজ সারাদিন শরীরের ওপরে খুব ধকল গেছে ভাস্কর। একদম মুড নেই। নিয়ো না।
ওকে ম্যাডাম, বলে ফোনটা কেটে দিল। আমাদের কলসালট্যান্সি উইথ থেরাপিতে কতগুলো প্রফেশনাল এথিক্স আছে। সেসবের প্রপার মেইনটেনেন্সের ওপর প্রফেশানটা গ্লোরিফাই হয়। তাৎক্ষণিক আবেগ এবং লোভ পরিহার করতে শিখতে হয়। এটা ভাস্করও জানে বলে দ্বিতীয়বার রিকোয়েষ্ট করেনি আমাকে। রাস্তায় দাঁড়াতে দাঁড়াতে বিষাক্ত গরমটা শরীরে অস্বস্তি বাড়িয়ে তুলছিল। পমেরও এসি ছাড়া চলে না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে সমানে ঘামছিল। মেয়েকে নিয়ে আবাসনের দিকে ফিরতেই মোবাইলে গভীর নিম্নচাপের নোটিফিকেশন ভেসে এল। সেইসঙ্গে ঝড় এবং প্রবল বৃষ্টির সম্ভাবনা।
ঝড় আমার খুবই ভালো লাগে। প্রবল ঝড়ে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে যায়। অনেক মানুষের বসতিকে জল গিলে ফেলে। ঝড় শিকড় ধরে উপড়ে দিয়ে যায়। হাহাকার ভেসে ওঠে। ঝড় আর জল যেন হাত ধরাধরি করে বলে, যা চরে খা গে যা। লড়াই করতে শেখ। আমাদের চাইতেও জীবন কতটা নিষ্ঠুর, ছিন্নমূল হওয়ার অভিজ্ঞতা দিয়ে শিক্ষা নিয়ে আয়। ঝড়ঝঞ্ঝায় শিকড় ওপড়ানোর ভেতরে স্বাবলম্বী হবার একটা জেদ তৈরি হয়। আমার সেইভাবে তৈরি হয়েছিল বলেই আমি ঝড়কে সবসময় বন্ধু ভাবি। ঝড় আমাকে অনেককিছু শিখিয়েছে। এখনও শেখায়। ঝড়ই আমাকে প্রথম রুখে দাঁড়াতে শিখিয়েছিল শ্রীরামপুরে আমার শ্বশুরবাড়িতে। তখন আমার বিয়ের বয়স ছিল মাত্র দেড় বছর। পম তখন তিন মাসের শিশু। প্রায় পনেরো দিন পর বেঙ্গালুরু থেকে অফিসের ট্যুর প্রোগ্রাম সেরে এসেছে সৌমিত। সৌমিতকে একা পাবার জন্য মনটা ছটফট করছিল ক-দিন ধরেই। দিনেরবেলা সেটা সম্ভব নয়। শ্বশুর শাশুড়ি আছেন, দু-জন ননদ আছে তারা কিশোরী। প্রমিত আছে আমার দেওর। ছোটোখাটো একটা ব্যাবসা করে বাড়িতে বসেই। প্রমিতের বিয়ের জন্য মেয়ের খোঁজ চলছিল সেইসময়। শ্বশুরবাড়ির বড়ো ফ্যামিলি। আমি ছিলাম বড়োবউ। সৌমিতকে একমাত্র রাতেই কাছে পাব প্রথম থেকেই এই অভাবটা খুব এনজয় করতাম। কোনো অসুবিধা অনুভবই করতাম না। শ্বশুর শাশুড়ি সহ বাড়ির সকলেই আমার প্রতি বেশ কেয়ারিং ছিল বলে সৌমিতের অভাবটা বোধ হত না। অফিসের কাজে মাসে দু-বার ব্যাঙ্গালুরু ট্যুর প্রোগ্রাম বাঁধা ছিল সৌমিতের। অভ্যাস করে নিয়েছিলাম। ঝড়ের রাতের কথা বলছি। সৌমিত এই প্রথম কোনো ইনফরমেশন না-দিয়ে প্রায় পনেরোদিন পার করে বাড়ি ফিরেছে। মনের ভেতরে একটা অভিমান তৈরি হয়েছিল কয়েকদিন ধরেই। সেদিন রাতেরবেলা শাশুড়ি আমাকে দশটার মধ্যেই রান্নাঘর থেকে রেহাই দিল। আমি ফ্রেশ হয়ে শোবার ঘরে ঢুকতেই শুনতে পেলাম সৌমিত ফোনে কার সঙ্গে উত্তেজিত হয়ে কথা বলছে। তিন মাসের পম তখন খাটে ঘুমোচ্ছে। ফোনের ওপাশে একজন মহিলা রীতিমতো আইনের মারপ্যাঁচ দিয়ে সৌমিতকে শাসাচ্ছে। সৌমিত ফোনের এপাশ থেকে তো তো করে যাচ্ছে। শোনার ইচ্ছা না থাকলেও আমি শুনতে বাধ্য হলাম দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। সৌমিত ঘেমে-নেয়ে আমাকে যখন লক্ষ করল তখন সবটাই আমি শুনে ফেলেছি। লুকোবার কিছু নেই। কোম্পানিতে ওই মহিলা ওর ওপর পোস্টে চাকরি করেন। হুমকির মধ্যেই সবটা বুঝতে পারলাম। সৌমিত সেই রাতে আমার কাছে বামাল সমেত ধরা পড়ে গেল। আমাকে সাফাই দেবার চেষ্টা করল, কোন পরিস্থিতিতে চাকরি বাঁচাতে ও লিভ টুগেদার করতে বাধ্য হয়েছে। ওটা আসলে বিয়ে নয়। আমি স্পষ্ট শুনেছি ওই মহিলা সৌমিতের কাছে বাচ্চা চাইছে। বাচ্চা না দিলে ও শেষ দেখে ছাড়বে। এটাও বুঝতে পারলাম ওই মেয়েটি আমার আগে। সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমার মিথ্যেবাদী সৌমিতের দিকে তাকাতে পর্যন্ত ঘেন্না করছিল। সেই ভয়ংকর রাতটা কোনোমতে একখাটে এপাশ-ওপাশ করলাম। ভোরের আলো ফোটার আগেই আমার নিজের গহনা কিছু টুকিটাকি ব্যবহারের জিনিস আর পমের পোশাক-আশাক ব্যাগে ভরে নিলাম। সৌমিত তখনও ঘুমোচ্ছিল। বাড়ির সকলে ওঠার আগে তিন মাসের পমকে নিয়ে সোজা শ্রীরামপুর স্টেশনে। সেখান থেকে ট্রেনে চেপে সরাসরি চন্দননগরে বাপের বাড়ি। বাবা মা দু-জনেই তখনও জীবিত ছিলেন। সেই ঝড়ের প্রথমেই বাবা এবং মা দু-জনে মিলে যথেষ্ট পরিমাণে বকাঝকা করেছিলেন আমার সিদ্ধান্তটা শুনে।
আর একবারও এরকম মারাত্মক ঝড়ে বিপর্যস্ত হয়ে ল্যাজেগোবড়ে জড়িয়ে পড়েছিলাম। ত্রাতা হয়ে উদ্ধার করেছিল ভাস্কর। ঘটনাটা ঘটেছিল কলকাতাতেই। বুকিংটা এসেছিল সরাসরি বাংলাদেশ থেকে। অনলাইনে সবটাই করেছিল ভাস্কর। পার্মানেন্ট কাস্টমার হোপ হেভেনের। ফলে একটা গিফ্ট প্রোজেক্ট অফার পেয়েছিলেন কাস্টমার। ভাস্কর আমাকেই প্রোজেক্ট অফারে রেকমেন্ড করেছিল। এ্যাটেন্ড করার আগে ভাস্কর আমাকে দুটো টিপস অগ্রিম দিয়ে রেখেছিল। এক, কাস্টমার প্রচন্ড মুডি এবং বদমেজাজি। নাম্বার দুই, কাস্টমার হার্টের পেশেন্ট। স্টেপ বাই স্টেপ যেন কেয়ারফুল হই। ফাইনালি এটাও বলেছিল, তা সত্ত্বেও এনি কাইন্ড অফ প্রবলেম, তার জন্য হোপ হেভেনের একটা নজরদারি সবসময় আপনার ওপর থাকবে। সেন্ট্রাল কলকাতা থেকে বুক করা ট্যাক্সিতে রাজারহাট নিউ টাউনের নির্দিষ্ট হোটেলে পৌঁছে গেলাম। হোটেলের রিসেপশনে খোঁজ করতেই বললেন আমাকে এখানে ওয়েট করতে হবে। রুমে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলছে। শেষ হলেই ডাকবেন। কাজে বেরিয়ে ফরনাথিং বসে থাকাটা খুবই বোরিং। রিসেপশনের মেয়েটি আমাকে কাছে ডেকে বলল, আপনার জন্য একটা ভার্বাল ইন্সট্রাকশন দিয়ে রেখেছেন স্যার। আপনার যদি অন্য কাজ থাকে তাহলে সেরে আসতে পারেন। আমি এইমাত্র রুমে ফোন করেছিলাম। বলল, মিটিং শেষ হতে এখনও ঘন্টাখানেক সময় লাগবে। তারপর ডিনার শেষ করতে করতে আপনি অনায়াসে এক ঘন্টার বেশি সময় পাবেন। এখানে বসে থাকবেন না অন্য কাজ থাকলে সেরে আসবেন? আমি মৃদু হেসে রিসেপশনিস্টকে সম্মতি জানিয়ে ওখান থেকে ভাস্করকে ফোন করলাম। ভাস্কর সবটা শুনে বলল, আপনি স্টেশন লেফ্ট করুন। বাকিটা আমি বুঝে নেব। আপনি সোজা আপনার ফ্ল্যাটে চলে যান। অযথা ওয়েট করবেন না। ফোন রাখতেই রিসেপশানের মেয়েটি বলল, ম্যাম আপনার ফোন।
ধরে হ্যালো বলতেই কাষ্টমারের গলা, হোপ হেভেন থেকে এসেছ কি?
হ্যাঁ…
আমি ঘন্টা দেড়েক পরে তোমাকে ডেকে নিচ্ছি। ডোন্ট টেক ইট আদারওয়াইজ!
না না, ইটস ওক্কে স্যর!
বলেই ফোনটা রেখে দিলাম। হোটেল থেকেই ফেরার জন্য একটা ট্যাক্সি বুক করলাম। রিসেপশনের মেয়েটি বলল, ম্যাম আপনার নাম্বারটি যদি এখানে রেখে যান প্রয়োজনে আপনাকে নক করতে পারব। এটাও আমাদের কাস্টমার সার্ভিসের মধ্যে পড়ে।
তারপর ট্যাক্সি আসতেই সোজা নিজের আবাসনে চলে এলাম। জানি যাতায়াতের পুরো ফেয়ারটা ভাস্কর রিফান্ড করে দেবে। সেইজন্য কোনো টেনশান ছিল না।
ফ্ল্যাটে এসে চেইঞ্জ করলাম। ডিনার সারলাম। ম্যাগাজিন ওলটাতে ওলটাতে একটা সময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। অনবরত ফোনটা বেজে চলেছে। ঘুমের মধ্যে বুঝতেই পারিনি। ঘুম চোখে ফোনটা ধরতেই একটা গম্ভীর পুরুষকন্ঠ ভেসে এল, আমি নিউটাউন থানার সাব ইন্সপেক্টর সুলতান কাদের বলছি। হোটেল পারাবতের রিসেপশান থেকে আপনার নাম্বারটা পেয়েছি। আপনাকে একবার নিউটাউন থানায় আসতে হবে।
এত রাতে! কেন বলুন তো?
হোটেল পারাবত-এ একজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী খুন হয়েছেন রাত বারোটা নাগাদ!
তো?
হোটেলের রিসেপশান জানালো আপনার সঙ্গে ওঁর এপোয়েন্টমেন্ট ছিল। এটাও বলেছে আপনার সঙ্গে ওঁর দেখা হয়নি। তা সত্ত্বেও কিছু লিগাল ফর্মালিটিজ আছে, অবশ্যই একবার থানায় আসবেন।
এখন রাত আড়াইটা বাজে, স্যর।
আগামীকাল সকালে অবশ্যই আসবেন।
ঠিক আছে!
বলতেই ওপাশ থেকে ফোন কেটে দিলেন সেই সাব ইন্সপেক্টর। আমি সেটটা কানের কাছে ধরেই থাকলাম।
ফোন বন্ধ হতেই সারা শরীর ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ভাবতেই পারছি না পুলিশের হাঙ্গামা থেকে কীভাবে রেহাই পাব। পমের সবে মাধ্যমিক পরীক্ষা হয়েছে। পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছে। চোখে সরষেফুল দেখছি। এই রাতে ভাস্করকে ফোন করব কি না ভাবছি। বিভিন্ন অসুস্থ চিন্তার মধ্যে বাকি রাতটা কাটিয়ে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভাস্করের ফোন সকালের ঘুম ভাঙিয়েছিল। ভাস্করের প্রথম অভিযোগ ছিল, ম্যাডাম আপনি ফোন নাম্বারটা রিসেপশনে দিয়ে এসেছিলেন কেন? দ্বিতীয়বার এইরকম ভুল কোথাও করবেন না। ফ্রেস হয়ে নিউটাউন থানায় আসুন। আপনার সঙ্গে ল-ইয়ার থাকবে। আপনার ভয়ের কিছু নেই। ভাস্কর সে-যাত্রায় আমাকে রক্ষা করেছিল। তারপর থেকে প্রফেশনাল জায়গায় ফোন নাম্বার অযাচিতভাবে কাউকে শেয়ার করি না।
এখন ভাবছি ভাস্করের ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারব না। বন্ধুর মতো অভিভাবকের মতো ভাস্কর আমাকে আগলে রেখেছে। ভাস্করের কথা বলতে হলে ঋতা বা ঋতাম্ভরীর কথাও চলে আসবে। ঋতাম্ভরী বসু আমার কলেজের বান্ধবী। কলেজ জীবনে এই একজনই ছিল আমার বোজম ফ্রেন্ড। প্রথম থেকেই ঋতার একটা কমান্ডিং এটিটিউট ছিল যা আমাকে খুবই আকর্ষণ করত। আমার বিয়ের আগেই ঋতা একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে যায়। পরিপূর্ণ স্বাবলম্বী ঋতাম্ভরী বসু। ঋতার কথাটাও এই মুহূর্তে একবালপুর থানাতে যেতে যেতে মনে পড়ছে। অবশ্যই মনে পড়ারই কথা! বিপদে না পড়লে মানুষ চেনা যায় না। কেন ঋতাম্ভরীকে মনে পড়ল আমার! শ্বশুরবাড়ি শ্রীরামপুর থেকে এক রাতের সিদ্ধান্তে চন্দননগরে চলে এসেছিলাম। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে মা বাবা আমাকে ওই অবস্থায় দেখে চমকে গিয়েছিল। চা জলখাবার হয়ে যাবার পর মা আমাকে ফেরত পাঠাতে বদ্ধপরিকর। তখন বাবার নীরবতা ছিল মায়ের পক্ষে। আমার জেদ এবং সিদ্ধান্ত যে একেবারে সঠিক ছিল বাবা সেটা বুঝেছিল একসপ্তাহ ওখানে থাকার পরে। সেটা বুঝেছিলাম সৌমিতের ছোটো ভাই প্রমিত আমাকে নিতে এলে। বাবা আমার সামনে খুব স্পষ্টভাবেই বলেছিল, কিছু মনে কোরো না প্রমিত, অনুশীলা আর তোমাদের বাড়ি যাবে না। সতীনের সংসার ও করবে না। আমি ডিভোর্স স্যুট করব কোর্টে। বেঁচে থাকতে থাকতে মেয়েটার জমিটাকে শক্ত করে দিতে চাই। আমার মা আর একটু সময় অপেক্ষা করতে চাইছিল। বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে সে সাহস পায়নি। প্রমিত কোনো কথা না বলে বাবা আর মাকে প্রণাম করে চলে গিয়েছিল। আর আসেনি।
কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
দেখতে দেখতে পমের ছয় মাস বয়স হয়ে গিয়েছিল। সেইসঙ্গে জেদ আর কল্পনা আমার মধ্যে নতুন বোধের জন্ম দিল। আমি আমাকে নতুনভাবে দেখতে এবং ভাবতে শুরু করলাম। পমকে ঘুম পাড়িয়ে আয়নার সামনে নিজেকে দেখতে শুরু করলাম খুঁটিয়ে। ভাবতে শুরু করলাম কী আমার যোগ্যতা! পাঁচ ফিট তিন ইঞ্চি আমার হাইট। গায়ের রং গমের দানার মতো ফর্সা। চোখ নাক মুখ খুবই তীক্ষ্ম। সুন্দরী বলে একটা প্রচার ছিল স্কুলে পড়াকালীন। পরিপূর্ণ টের পেয়েছিলাম কলেজে পড়ার সময়ে। বেশিরভাগ ছেলেরা আমার সঙ্গে প্রেম করতে উঠেপড়ে লেগেছিল। কলেজে তখন ঋতাম্ভরী আমাকে আগলে রাখত। একজন সাধারণ মানের স্নাতক আমি। এই যোগ্যতায় একমাত্র জীবনের প্রথম সম্বন্ধেই বাইশ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এই সামান্য যোগ্যতা নিয়ে এই সমাজে কীভাবে অর্থনৈতিক স্বাধীন হব আমি! আমার মতো হাজার হাজার মেয়ে স্বাবলম্বী হতে শহরে বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এইভাবে প্রতিদিন যত বাস্তবের মুখোমুখি হচ্ছি নিজেকে অসহায় একটা নিকৃষ্ট জীব মনে হচ্ছে। আত্মগ্লানিতে ভুগতে লাগলাম। আমাকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই হবে। মনের মধ্যে আবার জেদ। সেদিন ছিল রবিবার। বাবা আর মায়ের জিম্মায় পমকে রেখে সকাল দশটা নাগাদ তৈরি হয়ে বেরোলাম। চন্দননগর থেকে চুঁচুড়া এলাম। চুঁচুড়া থেকে টোটো ধরে এলাম ঘড়িরমোড়ে। বাসষ্ট্যান্ডের কাছাকাছি রাস্তাটা দু-বছর আগেও সড়গড় ছিল। এখন এখানে দাঁড়িয়ে চেনা রাস্তাগুলো কেমন যেন সব গুলিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে মাথাটা ঠিক করে পুরোনো রাস্তাটাকে নলেজে নিয়ে এলাম। রাস্তাটা খুঁজে পেতেই বাড়িটাও পেয়ে গেলাম অনায়াসে। গেট খুলে ভেতরে ঢুকতেই ঋতা ওদের বারান্দা থেকে আমাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে স্বাগত জানিয়ে বলল, আয় আয় অনুশীলা, আমাকে তাহলে মনে রেখেছিস। আগের চাইতেও অনেক সুন্দর লাগছে তোকে। সত্যিকথা বলতে কী আমি খুবই আপ্লুত হয়ে গেলাম ঋতাম্ভরীর আপ্যায়নে। আজ ছুটির দিন রবিবার বাড়ির সকলেই আছে। ছুটির দিন ছাড়া ঋতাম্ভরীকে পাওয়াও যাবে না। ওদের ঘরের ভেতরে ঢুকতেই পুরোনো দিনটা ফিরে পেলাম। মাসিমা মেসোমশাই দাদা বৌদি ছোট্ট সদস্য ভাইপো আনন্দ, আর ঋতা, জমজমাট আড্ডা। আমার হঠাৎ চলে আসাটাকে ওরা প্রত্যেকেই বেশ এনজয় করল। পুরোনো দিনের কথা, কলেজের কথা, পিকনিকের কথা, একসঙ্গে জমিয়ে বসে আড্ডা মারতে মারতে খাওয়ার মধ্যে ওরা যখন জানতে পারল আমার ছয় মাসের একটা মেয়ে আছে, সেটাকে মা বাবার জিম্মায় রেখে এসেছি; ওদের সবাইকে কথা দিতে বাধ্য হলাম এইরকম আর একটা ছুটির দিনে মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে যাব। কথা নিয়েই ছাড়ল। হাসছি কথা বলছি মজা করছি কিন্তু মনের ভেতরটা খচখচ করতে লাগল। যেইজন্য এলাম; ঋতাকে একা একা পাব। মনের কথা শেয়ার করব। সেরকম কোনো সুযোগই পাচ্ছি না। ঋতাও আমাকে একা শেয়ার করছে না। সবার সঙ্গে সবার মাঝে বসে গল্প করে যাচ্ছে। খাওয়াদাওয়ার আগে বোধ হয় আমার মনের ভেতরটা বুঝতে পারল ঋতা। আড্ডার মাঝখানেই বলল, অত চিন্তা করিস না অনুশীলা, আমি নিজে গিয়ে তোকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসব। কথাটা শোনার পর অনুভব করলাম আমাদের মুখটাই একটা বইয়ের মতো যেটা নিখুঁতভাবে দেখলে পড়া যায়। ঋতাম্ভরী সেটাই এতক্ষণ ধরে পড়ে আমাকে আশ্বস্ত করল। আমাকে ও সময় দেবে শুনে বন্ধুর প্রতি একটা চোখে জল আনা অনুভূতি রণিত হতে থাকল।
ঋতাম্ভরী গেট দিয়ে বেরিয়েই আমাকে বলল, এবার বল আমার কাছে তোর হঠাৎ আগমনের কারণ?
কোনো কারণ ঠিক নয়, হঠাৎ মনে হল তোর সঙ্গে কতদিন কথা হয় না, দেখা হয় না। কিছুটা সঙ্কোচেই বললাম। বলতেই কলেজের পুরোনো মেজাজে ধমকে উঠে বলল, ছয় মাসের বাচ্চা ফেলে কেউ এমনি দেখা করতে আসে না, সারা বাড়িতে আমাকে একটু একা পাবার জন্য ছটফট করে না। শুরু কর। ঋতার সেই পুরোনো কমান্ডিং। আমি বললাম, আমি তো শ্বশুরবাড়ি থেকে একবারেই চলে এসেছি। আসলে আসতে বাধ্য হলাম।
জানি!
কীভাবে জানলি!
এসব ছাড়াছাড়ি আর ধরাধরির খবর বাতাসে উড়ে বেড়ায়। শুনতে না চাইলেও কানের ভেতরে গুঁজে দিয়ে যায়। যতদূর শুনেছি ডিভোর্স স্যুট করেছিস কোর্টে।
আমার ইচ্ছায় বাবা উকিল ঠিক করেছে। আমি শুধু সই করেছি।
আমার কাছে এসেছিস কেন?
আমার তেমন পরিচিতি নেই যে কারও কাছে যাব। বাবার পেনশানের টাকায় মেয়েকে নিয়ে মাথার ওপর চেপে বসেছি, ছয় মাসের একটা মেয়ের খরচ একেবারে কম নয়। আমাকে একটা জবের ব্যবস্থা করে দিতে পারবি?
ওইভাবে কথা দিতে পারব না। ফোন নাম্বার তো রইল। সবসময় আমাকে ফোন করলেই পাবি না বলে দিলাম। চেষ্টা করে দেখতে পারি। তারপর থেকে একটা আশা-আকাঙ্ক্ষার দোলা আমাকে দোলাতে শুরু করে দিয়েছিল। হতাশা গ্রাস করলে ঋতাম্ভরীকে কল্পনায় নিয়ে আসতাম। কেন জানি না ঋতাম্ভরী আমার বিশ্বাসের জায়গাটা পুরো দখল করে বসেছিল।
ঠিক একইভাবে ভাস্কর আমার বিশ্বাসের জায়গাটা দখল করে নিয়েছে। আমাকে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছে। সেইসব এসাইনমেন্টে আয়ও হয়েছে, শিখেছিও অনেক। সব চাইতে চমকে গিয়েছিলাম একটি মাল্টিন্যাশনাল ওষুধ কোম্পানির প্রজেক্টে অংশগ্রহণ করে। বলা যায় আমার মাইন্ড থেরাপি কনসালটেন্সির একটা গোল্ডেন অপরচুনিটি ছিল সেটা। আর সেটা হয়েছিল কলকাতাতেই। আমাকে সকালের দিকে হোপ হেভেন-এ আসার জন্য ফোন করে জানিয়েছিল ভাস্কর। আমি যথাসময়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম হোপ হেভেনে। ভাস্কর অপেক্ষা করছিল। আমি পৌঁছালে টেবিলের ওপরে রাখা তিনটে প্রডাক্ট ব্রোসার্স দেখিয়ে ভাস্কর আমাকে বলল, এই তিনটি প্রোডাক্টকে মাইন্ড থেরাপির সঙ্গে ইন্ট্রোডিউস করতে হবে আপনাকে। সেই কাজটা হবে কোম্পানির সিলেক্টেড কাস্টমারের কাছে। এই প্রোজেক্টের সঙ্গে মার্কেটিংটা এ্যাড হয়ে আছে বলে এটা একটা চ্যালেঞ্জও বটে। দেখে নিন ভালো করে। দেখা তো দূরের কথা প্রোডাক্টের মার্কেটিং করতে হবে শুনেই বলে দিলাম, কোনো চ্যালেঞ্জ নিতে আমি পারব না ভাস্কর। আমি সেলস বুঝি না, বুঝতে চাই না। যেভাবেই কাজ করছি সেভাবেই করব। ভাস্কর খুবই ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। আমার অনাগ্রহটা জেনে বলল, আগে পুরোটা শুনে নিন ম্যাডাম, তারপর অপছন্দ হলে ক্যানসেল করে দেবেন। ভাস্করের ব্যাক্তিত্বের কাছে আমি নত হয়ে বললাম, বলুন শুনছি।
না না, অত সিরিয়াস মুডে নয়, রিল্যাক্স মুডে শুনুন। বলার কায়দাতে আমি হেসে বললাম, একদম ন্যাচারাল মুডেই শুনছি ভাস্কর।
এই মাল্টিন্যাশনাল ওষুধ কোম্পানিটি ক্যাটালগ দেখে বায়োডাটা চেক করে আপনাদের পাঁচ জনকে সিলেক্ট করেছেন। ওরা নেফ্রলজিস্ট, হার্ট স্পেশালিষ্ট, মেডিসিনে এমডি মিলিয়ে মোট দু-শো জন ডাক্তারের মধ্যে পনেরো থেকে কুড়ি জনের দায়িত্ব আপনাকে দেবে। আপনার পারিশ্রমিক বাদেও ব্রোসার্স ডিসপ্লের জন্য আলাদা একটা ইনসেনটিভ আছে, যার পরিমাণটাও খুবই লোভনীয় আপনি পাবেন। এইবার এই প্রোজেক্টে আপনাকে উপযুক্ত করার জন্য কোম্পানি কয়েকজন ট্রেনার দিয়ে ট্রেনিং করাবেন। ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণ করার জন্যও কোম্পানি আপনাকে পেমেন্ট করবেন। ট্রেনিংয়ের পর আপনার যদি মনে হয় প্রোজেক্টটা ভালো লাগছে না, বা পারবেন না, ছেড়ে দিতে পারবেন। এবার ভেবে আমাকে বলুন। আমার ধারণা ম্যাডাম, য়্যু আর ওয়ান অফ দ্য ফিটেস্ট গাই ফ্রম দ্যা ফিল্ডারস। বলা শেষ করে মৃদু হাসলেন।
ভাস্করের কথায় ফেঁসে গেলাম। কনট্রাক্টে সই করলাম। ট্রেনিং করলাম। কাজে নেমে গেলাম। কাজটা খুবই এনজয় করলাম। অনেক নামকরা ডাক্তারদের মাইন্ড থেরাপি করতে করতে জীবনের আর এক অভিনব অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হলাম। তারপর থেকেই জানলাম, জীবনদায়ী ওষুধের মার্কেটিংয়ের নামে মেডিসিন কোম্পানির সামান্য খুঁটিনাটি কয়েকটি কথা। পাশাপাশি মাল্টিন্যাশনাল ওষুধ কোম্পানি বনাম ডাক্তারদের পারস্পরিক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা। সবটা গুছিয়ে মাথায় রাখাটা আমার মেধায় সম্ভব নয়। ওপর ওপর কয়েকটা জিনিস বুঝেছি। যেমন হার্ট এ্যাটাক হলে স্ট্রেপ্টোকাইনেজ ইঞ্জেকশন লাগে। ইঞ্জেকশনের গায়ে এমআরপি লেখা থাকে নয় হাজার টাকা। যেটার দাম হওয়া উচিত সাত-শো টাকা। কোম্পানিগুলোর প্রতিযোগিতা হচ্ছে কটা হার্ট স্পেশালিস্টকে ওদের কবজায় রাখতে পারবেন, ওদের এই ওষুধটা লেখাতে পারবেন। তারজন্য ডাক্তার অনুসারে পাঁচটা ‘ম’ এর ঢালাও পরিসেবা দেওয়া হয় রিসার্চ এণ্ড কনফারেন্সের শিডিউল প্রোগ্রামে। টাইফয়েডের জন্য মনোসেফ, যার দাম হওয়া উচিত পঁচিশ টাকা, ফার্মেসিতে তার দাম পঞ্চাশ থেকে ষাট টাকা। নার্সিং হোমের রেট আর একটু বেশি। কিডনি ফেইলিওর হলে সপ্তাহে দুই দিন ডায়ালিসিস করাতে হয়। ডায়ালিসিসের আগে যে ইঞ্জেকশনটা দেওয়া বাধ্যতামূলক সেটা খোলাবাজারে বিক্রি হয় না। নেফ্রোলজিস্ট আর নার্সিং হোমেই একমাত্র কোম্পানিগুলো সাপ্লাই করেন। পেশেন্ট পার্টি আঠেরো-শো থেকে দুই হাজার টাকায় কিনতে বাধ্য হয় সেই ইঞ্জেকশন। তারজন্য কোম্পানিগুলোকে ডাক্তার ধরার ফাঁদ পাততে হয়। আমি ছিলাম সেই ফাঁদের একটা জাল। সংক্রামক রোগের এন্টিবায়োটিক ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনে কিনলে পাঁচ-শো চল্লিশ টাকা। খোলাবাজারে প্রেসক্রিপশন ছাড়া কিনলে এক-শো পঞ্চাশ টাকা। সেটাই জেনেরিক কিনলে মাত্র পঁয়তাল্লিশ টাকা। ডাক্তার আর নার্সিং হোম জেনেরিক কখনোই দেবেন না কোম্পানির শর্ত মেনে। আবার যেকোনোরকম আলট্রাসাউন্ড টেস্টের খরচ মাত্র দুই-শো চল্লিশ টাকা, বাকিটা ডাক্তারের কমিশন। কমিশন না পেলে পেশেন্ট পাঠাবে না। আমাদের পাঁচ জন থেরাপিস্টের জন্য কোম্পানি যা খরচ করেছেন তার কয়েক হাজার গুণ বেশি প্রফিট করবে, আমাদের খাঁচায় ভরে দিয়ে আসা পোষা ডাক্তারগুলোকে দিয়ে। ভাস্করের সঙ্গে পরিচয় না হলে এই কৃত্রিম এবং ভণ্ড একটা সমাজের স্বার্থপর লোভী জগৎটাকে জানতেই পারতাম না। ঋতাম্ভরী, আমি তোর কাছেও কৃতজ্ঞ। তুই তো আমাকে ফোন করতে বারণ করে দিয়েছিলি। আমি দু-বারের বেশি তোকে ফোন করিনি। তোর ফোনের জন্য অপেক্ষা করেছিলাম প্রায় দুইমাস। সত্যিই একদিন কথা রেখে ফোন করেছিলি তুই।
মোবাইলে কলটা আসার পরে বার বার নাম্বারটা দেখছিলাম। ঋতাম্ভরী ফোন করেছে। দ্বিতীয়বার ফোন করাতে ও বলেছিল, চেষ্টা করছি। ওইটুকু আশাই মনের মধ্যে জ্বলছিল। রিসিভ করে বললাম, তোর ফোনের জন্যই অপেক্ষা করেছিলাম। বল।
কিছু জোগাড় করতে পেরেছিস? ঋতা জিজ্ঞেস করল।
না রে! মা কাকে যেন বলেছিল টিউশনি জোগাড় করে দেবার জন্য। তাও তো প্রায় দুই সপ্তাহ হয়ে গেল। কোনো খবর নেই। তুই কিছু করতে পারলি! বলতে বলতে আমি প্রায় ভেঙে পড়লাম।
তোর একটা বায়োডাটা তৈরি করতে পারবি? ঋতা জিজ্ঞেস করল।
তোকে কবে দিতে হবে?
আমাকে দিতে হবে না। একটা বায়োডাটা তৈরি করবি। অবশ্যই কম্পিউটার প্রিন্ট হতে হবে। তার সঙ্গে তোর যা যা সার্টিফিকেট আছে সব একটা ফাইলে ভরে আগামী মঙ্গলবার এগারোটা দশের গাড়ি ধরার জন্য চুঁচুড়া স্টেশনে চলে আসবি। আমি স্টেশনে থাকব। তোকে নিয়ে কলকাতা যাব।
আনন্দে আমার কথা বন্ধ হয়ে গেল। ওপাশ থেকে ঋতা বলেই যাচ্ছিল, হ্যালো হ্যালো অনুশীলা, আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস।
আমি কোনোমতে বললাম, শুনছি বল।
কোনো কারণে তুই যদি না যাস আমাকে আগে জানিয়ে দিবি। মাঝখানে তিন দিন সময় পাচ্ছিস। আমি ওইদিন তোর জন্য অফিস কামাই করব।
আমি বললাম, তুই শিওর থাক আমি আগামী মঙ্গলবার সকাল এগারোটার আগে কাগজপত্র নিয়ে চুঁচুড়া স্টেশনে পৌঁছে যাব।
নির্দিষ্ট মঙ্গলবারে ঋতাম্ভরী আমাকে নিয়ে এল পার্কষ্ট্রিটে। বিয়ের আগে মাত্র দু-বার এসেছিলাম কলকাতার এই বনেদি পাড়ায়। দু-বারই বো-ব্যারাকের ক্রিসমাসের অনুষ্ঠানে বন্ধুদের সঙ্গে। পার্ক স্ট্রিটের বড়ো রাস্তাটা দিয়ে অনেকটা হেঁটে বামদিকে একটা রাস্তায় এলাম। একটা বড়ো অফিস। সেখানে গ্রাউন্ড ফ্লোরের ভেতরে ঢুকে ভিজিটার্সের সিটে গিয়ে বসলাম আমরা দু-জন। বসার কিছুক্ষণ পর একজন আমাদের কফি দিয়ে গেল। যিনি কফি দিয়ে গেলেন ঋতাম্ভরীকে চেনে। কফি দিতে দিতে বলল, স্যর আপনাকে বসতে বলল। ক-জনকে ছেড়ে আপনাকে ডাকবে। ঋতাম্ভরী মুখে কিছু না বলে মিষ্টি করে হাসল। আমি চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগলাম ফ্লোরের চারদিকটা। প্রত্যেকের সামনে কম্পিউটার স্ক্রিন, কানে হেডফোন লাগানো। সবাই প্রায় আমার সমবয়সি ছেলে এবং মেয়ে। প্রত্যেকেই কথা বলছে! কার সঙ্গে কী বলছে সেটাই বোঝা যাচ্ছে না। কথা বলতে বলতে হাসছে। আমি চোখ দিয়ে শুধু গিলে যাচ্ছিলাম। ঋতাম্ভরী আমার এই কৌতূহলী চোখ ঘোরানোটা দেখে বলল, এটা একটা কল সেন্টার। অনেকগুলো কম্পানির কাস্টমার কেয়ার এখান থেকে কন্ট্রোল করা হয়। ওদের কাছে কোম্পানির ভ্যারাইটিস চিপস আছে, কাস্টমারের কোয়ারিজ অনুযায়ী সেগুলো চালিয়ে দেয় ওরা। কাস্টমারের কোম্পানির সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন হলে এখান থেকেই ওরা পিআরও-র কাছে লাইন করে দেবে। মনে মনে ভাবলাম কোথায় কোম্পানি আর কোথায় কাস্টমার কেয়ারের অফিস!
বড়ো জোর চল্লিশ বেয়াল্লিশ বছর বয়স। কানের ওপর থেকে দু-ইঞ্চি ফাঁকা রেখে ছোটো করে চুল ছাঁটা। ধবধবে ফর্সা একজন মানুষ গ্রে কালারের টাই স্যুট পরে টেবিলের উলটো দিকে বসেছিলেন। আমাদের ভেতরে ঢোকার সময় সম্বোধন করে বললেন, ওয়েলকাম ঋতাম্ভরী ম্যাম। সামনের চেয়ারে আমরা দু-জন বসলাম। ঋতাম্ভরী বসতে বসতে হাতজোড় করে নমস্কার করল। আমাকে দেখিয়ে বলল, আপনাকে ওর কথাই বলেছিলাম। ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলেন। ঋতাম্ভরী আমাকে ইশারা করতেই আমার পেপারস্গুলো ভদ্রলোকের সামনে দিলাম। সার্টিফিকেটগুলো দেখলেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। তারপর বায়োডাটা সহ ফোটোকপিগুলো রেখে ওরিজিন্যালগুলো ফাইলে ভরে ফেরত দিতে দিতে বললেন, বাড়িতে এখন আপনার কে কে আছেন? বললাম, আট মাসের একটা মেয়ে আর বাবা-মা। জিজ্ঞেস করলেন, প্রথম ছ-মাস আমাদের কনসেপ্টগুলোর সঙ্গে পরিচিত হবার ধৈর্য রাখতে হবে। খুবই সামান্য একটা স্যালারি পাবেন। ছ-মাস পরে আপনার ডেভলপমেন্ট আপনাকে চমকে দেবে। রাজি আছেন? ভদ্রলোকের কথা আমি কিছুই বুঝলাম না। কিন্তু বলার ভঙ্গিটা আমাকে মুগ্ধ করল। ঋতার মুখের দিকে তাকালাম। ঋতা আমাকে বলল, এদের মাল্টিপারপাস বিজনেস। মিউচুয়াল ফান্ড থেকে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সবটাই এঁরা করেন। তার মধ্যে কলসেন্টারও আছে। তোকে ছয় মাসের মধ্যে এদের কোনো একটা কনসেপ্টে কাজ করে নিজেকে ফিটেস্ট প্রমাণ করতে হবে। তখন তোর ইনকামও বাড়বে? তুই রাজি থাকলে বল। প্রচণ্ড তৃষ্ণায় হাতের কাছে জল পেয়ে খাব কি খাবো না-র অবান্তর প্রশ্ন। আমি বললাম, আমি ছয় মাস কষ্ট করব। আমার একটা কাজের খুব প্রয়োজন। এবার সামনে বসা ভদ্রলোক ড্রয়ার থেকে কয়েকটি পেপার বের করলেন। তিন চার জায়গায় টিক মেরে দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, কাগজগুলোতে সই করে দিন। এটা আমাদের পাঁচ বছরের চুক্তিপত্র। নির্দ্বিধায় চারটে সই করার পর চুক্তিপত্রের হেডিংয়ে দেখলাম হোপ হেভেন কথাটা লেখা। সই করার পর ভদ্রলোক কাগজগুলো ড্রয়ারে রাখলেন যত্ন করে। ড্রয়ার বন্ধ করলেন। আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললেন, হোপ হেভেনে আপনাকে স্বাগত ম্যাডাম। আমরা কেউ কারও বস নই। অল উই আর এন আনডিভাইডেড ফ্যামিলি। আমাদের প্রথম শর্তগুলো হবে আন্তরিকতা, ন্যায়পরায়ণতা এবং দায়বদ্ধতা। এর সঙ্গে প্রথম এবং প্রধানতম শর্ত থাকবে গোপনীয়তা। আপনার গোপনীয়তা রক্ষার সঙ্গে কোম্পানির গোপনীয়তা রক্ষা হবে। সেটা আপনার ভাই বন্ধু বাবা মা কারও সঙ্গেই শেয়ার করতে পারবেন না। আপনার সমস্ত নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক হেডেক আজ থেকে হোপ হেভেনের। আমি আপনার বস নই, দাদা নই, স্রেফ ভাস্কর। আমাকে ভাস্কর বলেই ডাকবেন। আমাদের মধ্যে কোনো ফর্মালিটিজ থাকবে না। আজ থেকে আমরা পরস্পর ফ্রেন্ড গাইড এণ্ড ফিলোসফার। ভাস্করের কথা শুনতে শুনতে আর এক প্রস্থ কফি খেলাম ওখানে বসে।
বেরিয়ে এসে ঋতাম্ভরীকে জিজ্ঞেস করলাম, তুইও কি এই কোম্পানিতে চাকরি করিস?
না, আমি সফটওয়্যার ডিজাইনার। আমার কোম্পানি আলাদা। ভাস্কর আমাদের কাষ্টমার। ওর অনেক কাজ আমার টেবিলে হয়। আসে বসে কথা হয়। অনেক ছেলে-মেয়েকে ও কাজ দিয়েছে। আমার অফিসে বসে মাসখানেক আগে একদিন তোর মোটামুটি সবটাই ওকে বললাম। ও শুনে গেছিল। কিছু বলেনি। গত সপ্তাহে আমাকে এসে বলল, আমি একটা নতুন কনসেপ্ট নিয়ে কাজ করব, আপনার বান্ধবীকে বায়োডাটাসহ নিয়ে আসতে পারেন। এটুকু বুঝি, ভাস্কর সিনসিয়ার এবং ভালো ছেলে। তোকে বিপদে ফেলবে না।
তারপর থেকে অনেকগুলো বছর ভাস্করের দেখভালে আছি। বাবা-মা এক বছরের ব্যবধানে মারা গেছেন। চন্দননগরের বাড়িটা বিক্রি হয়েছে। ভাস্কর আমাকে পেছন থেকে সাহস দিয়েছে, সামনে আসেননি কখনোই। ভাস্কর এখন প্রায় প্রৌঢ়। একইরকমভাবে আমাকে রক্ষা করে চলেছেন হোপ হেভেনের মাধ্যমে। ভাস্করের ফোন করার টাইমিংটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ভাস্করের ফোন করার একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি।
চন্দননগর ছাড়ার বেশ কয়েকবছর পর ভিআইপি রোডে একটা বুকিং এ্যাটেন্ড করতে গিয়ে খুবই বিপদে পড়তে হয়েছিল আমাকে। পার্টি ব্যাঙ্গালুরু থেকে প্রোফাইল দেখে দু-ঘন্টার জন্য বুক করেছিল। এখন আমাদের প্রফেশানের সুবিধার্থে যেকোনো হোটেলে দুটো অথবা তিনটে ঘর রিজার্ভ রাখা হয় OYO পরিসেবা দেবার জন্য। রেটটা খুবই হাই। সেটা পার্টির হেডেক। আমার নয়। আমাকে পেমেন্ট করবে হোপ হেভেন। সন্ধ্যা ছ-টা থেকে রাত্রি আটটা দু-ঘন্টার জন্য হোটেলের একটি ঘর বুক করা হয়েছিল। আমি ডট ছ-টা দশে হোটেলে পৌঁছে দেখি পার্টি অলরেডি ঘরে পৌঁছে গেছেন। নির্দিষ্ট ঘরে নক করলাম। দরজা খুলল। ঘরে ঢুকে পার্টিকে দেখেই চমকে উঠলাম। আমার প্রাক্তন স্বামী সৌমিত। প্রাক্তন এই কারণে, আমাদের আইনত ডিভোর্স হয়ে গেছে। সৌমিতকে দেখে সামান্য বিব্রত হয়েছিলাম। এই কয়েক বছরে অনেকটাই পরিপূর্ণ সুন্দর হয়ে উঠেছে সৌমিত। শরীরের বাঁধুনিতে এসেছে গ্ল্যামার। এককথায় সৌমিতকে হঠাৎ দেখে খুবই সুন্দর লাগছিল আমার। আমাদের বিয়ের সময়ে ওর গোঁফ ছিল এখন গোঁফ কেটে ফেলেছে। আমাদের প্রফেশনাল এথিক্স অনুসারে ক্লায়েন্টের ব্যক্তিগত লাইফ জানতে চাইতে নেই। এটুকু বুঝেছিলাম সৌমিত খোঁজখবর করে ক্যাটালগ দেখে আমার পাত্তা বের করে আমাকেই বুকিং করেছে। আমার সম্পর্কে অনেককিছু জানার কৌতূহল ছিল সৌমিতের। মূলত পম এখন কোথায় এবং কী করছে। দেখা করতে পারবে কি না! আমার বর্তমান অবস্থানের ঠিকানা সবটাই। আমি দৃঢ়ভাবে বলতে বাধ্য হলাম, আমি আইনত ডিভোর্সি, তার বাইরে কোনো ব্যক্তিগত তথ্য আমার কাছে জানতে চাইবে না। আমি দেব না। ফর হুইচ য়্যু হ্যাভ বুকড মি, রিলিজ মি উইদিন টু আওয়ার্স। আদার ক্লায়েন্টস উইল বি ওয়েটিং ফর মি। একথা বলার পর সামান্য থম মেরে বসেছিল সৌমিত। না, কোনো নুইন্সেসি করেনি। পুরোনো দিনের মতো চিৎকার চেঁচামেচি বা নিজের ফেবারে দ্বিতীয় কোনো যুক্তি সাজায়নি। কর্পোরেট দুনিয়ার মানুষ বলে খুব সহজেই মেনে নিয়েছিল আমার প্রফেশনাল এথিক্সকে। আমাকে সামান্যতম স্পর্শও করেনি তারপর। দু-ঘন্টা সময় কিছুতেই কাটতে চাইছিল না। শুধু শুনে গেলাম সৌমিতের নতুন জীবনের কথা। প্রায় ঘন্টাখানেকের মতো ছিল কাস্টমার সৌমিত। বেরিয়ে যাবার পর আমি আরও কিছুটা সময় একা বসেছিলাম ওই ঘরে ঝড়ের ধাক্কাটাকে প্রশমন করার জন্য। ওপরে কোনো ভাবের বহিঃপ্রকাশ না ঘটালেও ভেতরে ভেতরে জ্বলে গেছিলাম। পম সেই বছরই উচ্চমাধ্যমিকে চারটে লেটার নিয়ে হায়ারফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছে। খুব খুশিতে ছিলাম মনে মনে। সৌমিতের আবির্ভাবে একটা বিমর্ষতা চেপে ধরল। পুরোনো একটা ক্ষতস্থান চিড়বিড় করে ধরা দিল। এইভাবে কতক্ষণ একা ঘরের মধ্যে বসেছিলাম মনে নেই। সংবিৎ ফিরল ফোন বেজে ওঠার পর। ভাস্করের ফোন। জিজ্ঞেস করল, আর কতক্ষণ?
বললাম, হয়ে গেছে বের হচ্ছি! বলেই ফোনটা কেটে দিয়ে বাস্তবে ফিরে এসেছিলাম।
আমার মতো কাজের মানুষ এভাবে বসে থাকতে থাকতে, নাহ্, আর সহ্য করতে পারছি না। কাজ ছাড়া এভাবে বসে থাকা যায়! বেরোনোটাই রিস্ক হয়ে যাচ্ছে। আজকেও বিকেল থেকে শহরটা পুরো নেমে এসে রাস্তায় দাঁড়িয়েছে। দাঁড়ানোই শুধু নয় প্রত্যেকেই ক্ষিপ্ত এবং প্রগল্ভ। রাত এখন ন-টার মতো। পমটাও এখনো ফিরছে না। কোথায় প্রতিবাদে বসে পড়েছে কে জানে! একা বসে-শুয়ে ল্যাপটপ নিয়ে নাড়াচাড়া করে যাচ্ছি। যাক, ফোনটা বেজে উঠল। পমের ফোন। রিসিভ করলাম, কি রে কখন ফিরবি? একা একা ঘরে বসে বোর হচ্ছি!
ম্যাডাম, আমি একবালপুর থানা থেকে সাব ইন্সপেক্টর ইন্দিরা রায় বলছি।
কী ব্যাপার! এটাতো পমের নাম্বার! পম এখন কোথায় আছে। ও কি সুস্থ আছে?
একদম সুস্থ আছে আপনার মেয়ে পম ওরফে অভিষিক্তা চ্যাটার্জি। আপনি এক্ষুনি একবার একবালপুর থানায় আসুন।
কেন? পম এখন কোথায়? আমি প্রায় আর্তনাদ করে জিজ্ঞেস করলাম।
আপনার পম এখন থানার লকআপে আছে ! শুনেই আমি ভেতরে ভেতরে চমকে উঠলাম।
কী করেছে ও! আমার মেয়েকে লকআপে রেখেছেন কেন? বলুন!
আপনি সবটাই জানতে পারবেন একবালপুর থানায় এলে। এর বেশি ফোনে বলা সম্ভব নয়। বলেই ফোনটা কেটে দিল। আমি রিং ব্যাক করলাম। ফোন কেউ ধরল না। ভয়ে আর দুশ্চিন্তায় কয়েকবার রিং করলাম। ফোন ওঠালো না কেউ। বুঝতে পারলাম ফোন পমের কাছে নেই। পমের কথা চিন্তা করে ভয়টা আতঙ্ক হয়ে আমার শরীরটা কেঁপে উঠছে বার বার। ভাবলাম ভাস্করকে ফোন করে একটা এডভাইস নিই। কী একটা ভেবে শেষমেষ ভাস্করকে ফোন করলাম না। ফোনে একটা ওলা বুক করলাম একবালপুর থানায় যাবার জন্য। নিজে তৈরি হতে কিছুটা সময় লাগল। খুব তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে ওপর থেকে নীচে নেমে এলাম। সাব ইন্সপেক্টর ইন্দিরা রায়ের কথাগুলো কানে বাজছে। মহিলা শেষের কথাটা মেজাজ গরম করেই বলেছেন। ওলাতে বসার পর শরীরটা আবার চক্কর দিয়ে উঠল। মাথাটা হিজিবিজি হতে হতে ক্রমশ অবশ হয়ে যাচ্ছে আমার হাত আর পা! প্লিজ, ড্রাইভার ভাই এসিটা বাড়িয়ে দিন!
থানার সামনেটায় একটা বড়ো ভিড়। আমি চিনে চিনে ডিউটি অফিসারের সামনে গিয়ে বললাম, সাব ইন্সপেক্টর ইন্দিরা রায় কোথায় বসেন?
কী ব্যাপারে দেখা করতে চান বলুন! ডিউটি অফিসার জিজ্ঞেস করলেন।
আমার মেয়ে অভিষিক্তা চ্যাটার্জিকে উনি লকআপে রেখে আমাকে ফোন করেছিলেন!
আপনি অভিষিক্তা চ্যাটার্জির মা?
হ্যাঁ, বলুন আমার মেয়ে কোথায়?
ঠিক লকআপে নয়, আপনার মেয়েকে আমরা বসিয়ে রেখেছি। কিছুতেই গার্জিয়ানের ফোন নাম্বার দিতে চাইছিল না। পাঁচ জনকে এ্যারেষ্ট করেছিলাম আমরা। চার জনের গার্জিয়ানরা এসে বন্ডে সই করে তাঁদের মেয়েদের নিয়ে গেছেন। এখন আপনি বাকি। এত দেরি করে এলেন কেন?
কী চার্জে আমার মেয়েকে থানায় বসিয়ে রেখেছেন, সেটা বলা যাবে কি?
বাঁ-দিকের বারান্দা দিয়ে সোজা চলে যান। ডানদিকের ঘরে এসআই অতনু মণ্ডল আছেন। উনি সবটাই আপনাকে বলবেন।
আমি তাড়াতাড়ি বাঁ-দিকের বারান্দা দিয়ে এগোতেই দেখলাম পম একটা বেঞ্চির ওপরে বসে আছে। আমাকে দেখেই উঠে সামনে এসে কাঁদতে লাগল। আমি ওকে কিছু না বলে বেঞ্চিতে বসিয়ে দিলাম। ঘরের সামনে দাঁড়ানো সেন্ট্রিকে বললাম, অতনু বাবুকে বলুন ওর গার্জিয়ান এসেছে। সেন্ট্রি ভেতরে চলে গেল। আমি বেঞ্চে মেয়ের পাশেই বসলাম। এই বারান্দার শেষ মাথায় লকআপ। দু-জন আসামিকে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়ার সময় লক্ষ করলাম। পমকে লকআপের পাশেই বসিয়ে রেখেছে। আমি অপেক্ষা করছি মেয়ের পাশে বসে। কিছুক্ষণ পর ভেতরে ঢুকতেই জিজ্ঞেস করল, আপনি এসেছেন, অভিষিক্তার বাবা আসেনি?
আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে। আমিই অভিষিক্তার একমাত্র গার্জিয়ান। আমাকে বলুন।
মেয়েকে একটু ভদ্র হতে শেখান!
কী করেছে আমার মেয়ে!
ওরা পাঁচ-ছয়জন মিলে রাস্তায় ভিআইপি মুভমেন্টে প্রতিবাদের নামে ল এণ্ড অর্ডার ব্রেক করছিল।
প্রতিবাদ করাটা কী অন্যায় স্যর!
ন্যায়-অন্যায় বিচারক আমি নই। রাস্তায় আমাদের ভিআইপি ডিউটি করতে হয়। আপনার মেয়েকে এ্যারেস্ট করার পর বিকেল থেকে আপনার ফোন নাম্বার দিতে চাইছিল না। তর্ক করছিল। ওকে বসিয়ে রেখে বাধ্য হলাম ওর ফোন থেকে আপনাকে ফোন করতে। তার পরে খোঁজখবর করতে যা পেলাম তাতে আপনার জীবিকার সঙ্গে মেয়ের ঔদ্ধত্য আর ব্যবহার দুটোই সাংঘাতিক ম্যাচ করে যাচ্ছে।
কোথায় সই করতে হবে দিন। আমার মেয়েকে ছেড়ে দিন স্যর। অনেক রাত হল। বাচ্চা মেয়ে স্যর! ভুল করে ফেলেছে।
আপনি যে মোটিভেটেড সেক্স ওয়ার্কার আপনার মেয়ে জানে? অতনু মণ্ডলের কথাটা শুনেই আমি আবার নার্ভাস ফিল করতে লাগলাম। সংযতভাবে বললাম, আমার মেয়েকে ধরেছেন প্রতিবাদ করার জন্য। আমার প্রসঙ্গ এখানে আসে না স্যার। অতনু মণ্ডল আমার কথা শুনে বলল, নিজে হোয়াইট কালার বেশ্যাবৃত্তি করবেন আর মেয়েকে পাঠাবেন রাস্তায় প্রতিবাদ করতে! আবার থানায় ঢুকে ন্যায়-অন্যায় বোঝাবেন! এতটা সহ্য করব কেন আমরা? কী ভাবেন আমাদের!
আমি সকাতর অনুরোধ করে বললাম, আমার মেয়েটাকে ছেড়ে দিন স্যার। আমি কথা দিচ্ছি ও আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করবে না। এই বয়সটা তো স্যার ঔদ্ধত্য দেখাবার বয়স। কথা দিচ্ছি ও শুধরে যাবে।
আপনার মেয়ের কথার দাপট সেটা বলছে না। ও বলছে, ছেড়ে দিলেই আবার রাস্তায় একই কাজ করবে।
আমি ওকে বার বার বোঝাব স্যার।
সেটাই বাইরে গিয়ে মেয়েকে আগে বোঝান। আমি এখন রাউন্ডে বের হব। আমার ফিরে আসা পর্যন্ত মেয়েকে বোঝান। বলেই অতনু মণ্ডল ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে গেল। আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম। আর একটা নিম্নচাপের মারাত্মক ঝড়ের মুখোমুখি হবার অপেক্ষায়..!
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
মন্তব্য করুন