ইতিহাস, ভক্তিরস, প্রবঞ্চনা, ষড়যন্ত্র—আর পাশাপাশি বয়ে চলা তিন সময়কালের তিন কাহিনিতে একসূত্রে গেঁথে নির্মিত সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের নতুন ছবি ‘লহ গৌরাঙ্গের নাম রে’। যার বহুস্তরীয় অভিঘাত দর্শককে একইসঙ্গে মুগ্ধ ও বিস্মিত করে। ছবিটি দেখে এসে তাঁর সেই মুগ্ধতার কথা লিখলেন স্বাতী চট্টোপাধ্যায় ভৌমিক।
বহু বছর ধরে জল্পনার পর অবশেষে বড়োদিনে মুক্তি পেল সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জীবন অবলম্বনে ছবি ‘লহ গৌরাঙ্গের নাম রে’। তবে সৃজিতের ছবি বলেই আন্দাজ করা গিয়েছিল শুধুমাত্র নিমাই সন্ন্যাসীর জীবন এবং মৃত্যু এ ছবির বিষয়বস্তু হবে না। প্রত্যাশামতোই তিনি দর্শকদের উপহার দিলেন এক অনন্য ছবির অভিজ্ঞতা।
ছবির কাহিনি তিন ভাগে বিভক্ত, এবং অনেকাংশেই ইতিহাসনির্ভর। গল্পের একদিকের সুতো বাঁধা ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে, যখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর (দিব্যজ্যোতি দত্ত) নেতৃত্বে ভক্তি আন্দোলনে ভেসে যাচ্ছে পূর্ব ভারতের এক বিরাট অংশ। সূত্রের মধ্যবর্তী অংশ বাঁধা রয়েছে ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে। নাট্যাচার্য গিরিশ ঘোষ (ব্রাত্য বসু) ও ‘নটি কুলসম্রাজ্ঞী’ বিনোদিনী দাসীর (শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়) যুগ্ম প্রচেষ্টায় বাংলার রঙ্গমঞ্চ সাক্ষী হচ্ছে একের পর এক কালজয়ী নাটকের। এই অতি প্রাচীন ও অতীত ইতিহাসের সূত্র ধরে আসে শেষ কাহিনি, যা বর্তমান পৃথিবীতে এই শহরেই কোথাও অনুষ্ঠিত হচ্ছে সিনেমা পরিচালক রাই (ইশা সাহা) ও সুপারস্টার অভিনেতা পার্থসারথির (ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত) মধ্যে। পরবর্তী দুই অধ্যায়ের মধ্যে সাধারণ বিষয় চৈতন্যলীলা। কোথাও তা নাটকে অভিনয় হচ্ছে কোথাও বা সিনেমায়।
পরিচালক লিনিয়র বা একরৈখিক স্টাইলে গল্প বলতে ভালবাসেন না। সেটা তাঁর অন্যান্য কাজে আগেও দেখা গিয়েছে। বিশেষভাবে বলতে গেলে ইতিহাস আশ্রিত ছবি ‘জাতিস্মর’, ‘এক যে ছিল রাজা’, ‘গুমনামি’ সর্বত্রই নন-লিনিয়র ধারায় গল্প বলেছেন তিনি। একে সৃজিতের মুনশিয়ানা ছাড়া আর কিছুই বলা যাবে না কারণ এই একই স্টাইল অনুসরণ করতে গিয়ে অনেকেই সামলে উঠতে পারেন না। সৃজিত সেটাই বারবার করেন অনায়াসে। ছবি শুরুর প্রথম আধ ঘণ্টার মধ্যে তিনটি ভিন্ন টাইমলাইনের প্রায় সমস্ত মূল চরিত্র পর্দায় চলে এলে গুলিয়ে যাওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা থেকে যায়। অথচ এক্ষেত্রে তেমনটা তো হয়ই না, বরং প্রত্যেকের পরিচয়ও জানা হয়ে যায় কোনো ভনিতা ছাড়াই। তিনটি টাইমলাইনের জন্য বরাদ্দ তিন ধরনের আলো। শ্রীচৈতন্যের সময় এক অদ্ভুত স্বপ্নালু কুয়াশা ঢাকা থাকে পর্দা জুড়ে। গিরিশ ঘোষ ও বিনোদিনী পর্দায় থাকলে হলুদ আলোর ব্যবহার আর বর্তমান সময়ের জন্য ঝকঝকে পরিষ্কার সাদা আলো। এই তিন ধরনের আলো ও ক্যামেরার ভিন্ন ব্যবহার খুব সহজে দর্শককেও বাধ্য করে এক গল্প থেকে অন্য গল্পে বয়ে যেতে। কোথাও ধাক্কা লাগে না, বেমানান লাগে না।
এরপর আসে দৃশ্য নির্মাণ। বর্তমান কাহিনিতে যেভাবে রাই ও পার্থসারথির মধ্যে নয়না (সুস্মিতা চট্টোপাধ্যায়) ঢুকে আসে সেটা খুব একটা অচেনা প্রেক্ষাপট নয়। এমনটা হয়তো হয়েই থাকে, কিন্তু এই তিনজনের মধ্যে ঘটে চলা চড়াই-উতরাইকে সৃজিত যেভাবে ক্যামেরায় ধরলেন তা এককথায় অনবদ্য। নয়না কোথাও নেই। একবারই সে শুটিং সেটে এসেছিল অশান্তি করতে। তারপর পার্থ আর তার আইনি বিচ্ছেদ ঘটে। কিন্তু এর পরবর্তীতে ফোনের ওপারে থেকেও কীভাবে সে এই দু-জনের মধ্যবর্তিনী হয়ে ওঠে সেটাকে একই ফ্রেমে সৃজিত যেভাবে ধরেছেন তা সত্যি তারিফের যোগ্য। এ ছাড়াও রয়েছে সময়োচিত সেট সজ্জা, ফলে প্রাচীন কলিঙ্গের গম্ভীরা হোক কিংবা উত্তর কলকাতার রঙ্গমঞ্চ সবই চাক্ষুষ করার সৌভাগ্য হয় দর্শকদের। বলতে গেলে এ এক অদ্ভুত জার্নি, ঠিক যেমনটা ‘জুরাসিক পার্ক’ ছবিতে জন হ্যামন্ড এক থিয়েটারের সিটে বসিয়ে অ্যালান, এলি আর ইয়ানকে নিয়ে পর্দায় মানস সফর করিয়ে আনেন ডাইনোসর যুগ থেকে বর্তমানের পৃথিবীতে।
তবে, এ ছবির তিন কাহিনির যোগসূত্র শুধুই নিমাই সন্ন্যাসীর জীবন নয়। তার চেয়েও অনেক বেশি করে ষড়যন্ত্র এবং প্রতারণা এই ত্রিমুখী কাহিনির এক অমোঘ ভাগ্য নির্ধারক হয়ে উঠেছে। কোথাও বৈষ্ণব ও শাক্তের আদর্শগত লড়াই, কোথাও বা তথাকথিত পতিত সমাজের প্রতি ভদ্র সমাজের প্রবঞ্চনা, আবার কোথাও-বা শুধুমাত্র সুবিধাবাদী বিশ্বাসঘাতকতা ছবির অবশ্যম্ভাবী বিয়োগান্ত উপসংহার রচনা করেছে। তাই থ্রিলার হয়ে ওঠার সবরকম সম্ভাবনা থাকলেও মহাপ্রভুর অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে শেষ অবধি এ ছবি মাথা ঘামায় না। আবার ভক্তিরসের আবেগেও দর্শককে ডুবিয়ে রাখে না। বরং মহাপ্রভুকে ঘিরে বিভিন্ন রকম থিওরি ও মিথকে দর্শকের দরবারে পেশ করেই ক্ষান্ত দেন পরিচালক। জানলা খুলে রাখেন দর্শকের ভাবনার জগতের জন্য। মন্দিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে কোথায় উধাও হয়ে গেলেন শ্রীচৈতন্য? কেন তাঁর মৃতদেহ পাওয়া গেল না? নিত্যানন্দ (যীশু সেনগুপ্ত) উড়িয়ে দিলেন তাঁর দারুব্রহ্মে বিলীন হওয়ার প্রসঙ্গ। প্রেমের বাণী সম্বল করেও কেন চৈতন্যের এত শত্রু বেড়ে গেল? কেনই-বা বিনোদিনী অভিনয় ছেড়ে দিলেন? না কি ইচ্ছে করেই তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হল? পার্থসারথির সঙ্গে সম্পর্কের পরিণতি কী রাইয়ের প্রাপ্য ছিল? এইসমস্ত প্রশ্ন পরিচালক রেখেছেন আমার আপনার সবার কাছে। যে দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বড়দিনের সন্ধ্যায় পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে বসে আমি ছবিটা দেখলাম, সপ্তাহখানেক পরে বেশ কিছুটা খালি প্রেক্ষাগৃহে দেখতে বসে আপনি হয়তো সেভাবে দেখবেন না। সম্পূর্ণ অন্য এক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে ছবির শেষ নির্যাসটুকু বিভিন্ন মানুষের কাছে ভিন্ন ধরনের হবে। আবার এও ঠিক যে তিন কাহিনিতেই ঘুরেফিরে এসেছে ষড়যন্ত্রের খতিয়ান। কোথাও গিয়ে মিশে গিয়েছে রাইয়ের বলা কথা যা প্রায় মিথের মতোই বিশ্বাস করি আমরা, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মৃত্যু রহস্য নিয়ে যারাই ঘাঁটাঘাঁটি করেছে তাদের অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে। ঠিক সেভাবেই একটার পর একটা কাহিনিতে ‘সে চলে গেলেও থেকে যাবে তার স্পর্শ আমার হাতের মুঠোয়’কে সত্যি করে কাহিনি এগিয়ে চলে।
নাটকে যেভাবে একই অভিনেতাকে নানাভাবে ও নানা রূপে ব্যবহার করা হয় সিনেমায় তেমনটা করতে দেখা গিয়েছিল সত্যজিৎ রায়কে। সেই একই জিনিস সৃজিত করলেন অনেক বড়ো করে চার-পাঁচজন অভিনেতাকে নিয়ে। সুজন নীল মুখোপাধ্যায়, সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবদূত ঘোষ, সৌম্য সেনগুপ্ত ও অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিনটি টাইমলাইনে উপস্থিত করলেন ভিন্ন ভিন্ন রূপে। প্রথম দু-জন ঊনবিংশ শতকের প্রেক্ষাপটে অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি ও রসরাজ অমৃতলাল বসু। তাঁরাই আবার কেউ শ্রীচৈতন্যের অনুগামী আবার কেউ তার প্রতিপক্ষ। দেবদূত কোথাও রাজা গজপতি তো কোথাও রামকৃষ্ণ পরমহংসের একান্ত অনুরাগী অক্ষয় কুমার সেন। এরকম আরও উদাহরণ রয়েছে। বাংলা ছবিতে এইভাবে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে একই অভিনেতার ব্যবহার আগে সেভাবে দেখা যায়নি। এঁরা প্রত্যেকেই নিজগুণে সম্ভ্রম আদায় করে নেবেন।
প্রতিটি চরিত্রের কাস্টিং, বিশেষ করে প্রথম দুই টাইমলাইনের প্রত্যেকে যেন ইতিহাস থেকেই উঠে এসেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনজন অভিনেতার কথা বলা যায়। প্রথম, নিমাইয়ের ভূমিকায় দিব্যজ্যোতি। এত অবিশ্বাস্যভাবে তিনি চরিত্রের সঙ্গে মিশে গিয়েছেন যে মুগ্ধতার রেশ থেকে যায় ছবি শেষের পরেও। দ্বিতীয় শুভশ্রী। বিনোদিনী কঠিন চরিত্র, নিমাইয়ের ভূমিকায় বিনোদিনী আরও কঠিন। অভিযোগের জায়গা রাখেননি শুভশ্রী। ভক্তিরসে ডুবে গিয়ে দর্শককেও ডুবিয়ে ছেড়েছেন। আর তৃতীয় গিরিশ ঘোষের ভূমিকায় ব্রাত্য। এই চরিত্রে যে তিনি অনবদ্য অভিনয় করবেন তা প্রত্যাশিত ছিল। অবাক করে তাঁর অভিনয়ের পরিমিতিবোধ। কোথাও তিনি বিনোদিনীকে ছাপিয়ে যেতে চাননি। নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন আগাগোড়া। এ ছাড়া ছোট পরিসরে লক্ষ্মীপ্রিয়ার ভূমিকায় আরাত্রিকা মাইতি, রামকৃষ্ণ পরমহংসের ভূমিকায় পার্থ ভৌমিক বেশ ভালো। যীশুর নিত্যানন্দ মনে রাখার মতো। সুপারস্টার অভিনেতার চরিত্রে ইন্দ্রনীলকে মানিয়ে গেলেও নিমাই চরিত্রে তিনি একেবারেই মানানসই নন। এই একটিমাত্র ক্ষেত্রে অভিনেতার উচ্চতা এবং অভিব্যক্তি দুই-ই বেশ চোখে লাগে। ইশা নিজের ভূমিকায় সাবলীল।
সৃজিতের ছবিতে সংগীতের ব্যবহার বরাবরই মুগ্ধ করেছে। বিশেষ করে তাঁর ইতিহাস আশ্রিত ছবিতে গান এক বড়ো ভূমিকা পালন করে থাকে। ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তর সুরে অরিজিৎ সিংয়ের কন্ঠে ‘ক্ষণে গোরাচাঁদ ক্ষণে কালা’ শ্রোতাদের এক অনন্য অনুভূতিতে জারিত করেছে আগেই। পদাবলী কীর্তনের আঙ্গিকে তৈরি এই গান বাংলা ছবির ইতিহাসে এক মাইলস্টোন হয়ে থেকে যাবে আশা করা যায়। অপরদিকে মুগ্ধ করবে জয়তী চক্রবর্তীর কন্ঠে ‘দেখো দেখো কানাইয়ে’ গানটি। কবীর সুমনের নিজের কথা ও সুরে গাওয়া ‘সে চলে গেলেও’ গানটিও একবার শুনলে ভোলা যায় না।
চিত্রগ্রহণ এবং সংগীতের মতোই এ ছবির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভগুলি হলো চিত্রনাট্য, মেকআপ এবং সেট সজ্জা। কোনো দিক দিয়েই এ ছবি এক ইঞ্চি জমিও ছাড়েনি। পর্দায় আনার আগে ছবির বিষয়বস্তু নিয়ে সৃজিতের গবেষণা প্রতিটি দৃশ্যে স্পষ্ট। অনেকটা সময় নিয়ে গুছিয়ে ছবি করলে সে-ছবির আবেদন কিন্তু এক মাসে কাজ শেষ করা ছবির চেয়ে অনেকটাই বেশি হয় এ কথা পরিচালক যত তাড়াতাড়ি বোঝেন ততই ভালো। ছবির সংখ্যার চেয়েও তার গুণগত মান দর্শকের মনে অনেক বেশি করে থেকে যায়। এই বছরটা সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে আশা করা যায়। তাঁর সেরা ছবির তালিকায় এই ছবি নিঃসন্দেহে ওপরদিকে জায়গা করে নেবে। বছরের শুরুর দিকে মুক্তি পেয়েছিল তাঁর পরিচালিত ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’ ছবিটি। ‘লহ গৌরাঙ্গ...’ দিয়ে সৃজিত নিজেই তাঁর নির্মিত ছবির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠলেন। মাঝখান থেকে বড়োদিনে লাভবান হল বাঙালি দর্শক।
