preloader
বাংলা বইয়ের e-ভুবন
Menu Categories Search Cart 0
Menu
Cart

Total 0 Items

☹ Your cart is empty

Sub Total:

$0

₹0

বিভাগ
পেত্মানি
প্রবন্ধ

পেত্মানি

পিতৃতন্ত্রের অন্ধকার গহ্বর, গ্রামবাংলার লোকবিশ্বাস, ‘পেত্মানি’ আখ্যায় দাগিয়ে দেওয়া নারীর দুঃসহ বাস্তবতা—এই শক্তিশালী লেখাটি তুলে ধরে সমাজ কীভাবে প্রশ্ন করা, ভালোবাসা বা স্বাধীনতার অধিকারকে অপরাধ বানায়। এটা শুধু গল্প নয়, নারীর বহু প্রজন্মের সত্যের ইতিহাস।

ভূত আমার পুত
পেত্নি আমার ঝি
আল্লাহ খোদা সাথে আছে
করবি আমার কী!

—ছোটোবেলায়, এমনকি একটু বড়ো হয়েও, যতটা বড়ো না হলে খেলাধুলো বন্ধ হয়ে যায় না মেয়েদের, সেইসময় মাঠ থেকে বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে ফেরার সময়, আমরা জোরে জোরে দৌড়াতাম আর এই ছড়াটি বলতাম। কে শিখিয়েছিল জানি না, ব্যস শিখে গিয়েছিলাম। গ্রামে এমনি এমনি অনেক কিছু শিখে যায় সবাই। গড়াতে গড়াতে নদীর মধ্যে পাথরের মতো।
তারপর গ্রামের একমাত্র প্রাইমারি স্কুল ভুরুঙ্গের বাড়ি স্কুলের পাশে একটা বাড়িতে, একজন মহিলাকে পেত্মানি ধরেছে বলে শুনলাম। মাঝে-মাঝেই মহিলাদের পেত্মানি ধরেছে বলে শুনতে পেতাম। পেত্নি বা মহিলা ভূতকেই পেত্মানি বলা হত।
শুধু মহিলাদের কেন ধরে?—নানিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। নানি বলেছিল সন্ধে বেলা বাড়ির বাইরে গিয়েছিল তাই।
পুরুষরাও তো যায়, তবে?
নানি কিচ্ছু উত্তর দেয়নি, শুধু বলেছিল—“তুই বড়ো উকিল লার মতন জেরা কাটিস।”

পেত্মানি ধরলে মানকচু ভরে দেওয়া হত যৌনাঙ্গে কিংবা কানের ফুটোর ভিতরে, নির্ভর করত পেত্মানির ক্ষমতার উপর। যত নাছোড়বান্দা সে, তত বড়ো তার দাওয়াই! পেত্মানি যে ধরেছে তা ঠিক করত গ্রামের ওঝা বা মৌলভি। সব পুরুষ মানুষ।
পাশের বাড়ির দুলাল মামার বউ মামি যখন সবার মতে ভুলভাল বকছিল, অথচ যা বেশিরভাগই সত্যি কথা, একটু বেশিই সত্যি কথা, ডাকা হলো কচু মুনশিকে। সে মানকচুর শিকড় নিয়ে এল। আমরা বাঁশের বেড়ার ওপার থেকে শুনতে পেলাম, মামির গলায় পেত্মানি বলছে,
“মুই যাছো, মুই যাছো… মোক তোমরা ছাড়ি দাও”, আর বেড়ার এপাশে দাঁড়ানো সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল, যাক মানকচু কাজ করেছে!
আমাদের গ্রামে অতি প্রচলিত স্ল্যাং “মানা দিম।”
কোনো মহিলার সাথে গ্রামে ঝগড়া হলেই বলত—“মানা দিম!” (মানকচু যৌনাঙ্গে ঢুকিয়ে দেব)। একমাত্র মহিলাদের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হত এই গালি।

পেত্মানি ধরার আরেকটা ঘটনা খুব স্পষ্ট মনে পড়ে জাকিরুল-এর বউ এর। জাকিরুল এর বউ—আমাদের গ্রামের মহিলাদের পরিচয় এমনই হয়, “অমুকের মাইয়া (বউ), তমুকের মাইয়া (বউ)।” নব্বই-এর দশকের একদম শেষ দিক। আমার বয়স তখন ১১-১২ বছর। জাকিরুল-এর বিয়ে ঠিক হল মালবাজারের শালবাড়ির একটি গ্রামে। তখন নানি অসুস্থ। তা নাহলে গ্রামের যে-কোনো বরযাত্রীতে নানি যেত আর সাথে আমি। নানি যেতে পারল না। তাই আমি গেলাম। আমাদের এইদিকে মুসলিমদের বিয়ে রাতেই হয় (মালদা, মুর্শিদাবাদে বিয়ের বরযাত্রী আমি দিনে যেতে দেখেছি)। গরুমারা ফরেস্ট লাগোয়া বাড়ি, যে-কোনো সময় মহাকাল আক্রমণ করতে পারে, তাই দিনের আলো থাকতে-থাকতেই নতুন বউ নিয়ে বাড়ি। তখন মুসলিমরাও হাতিকে মহাকাল বলত। এর সাথে মহাকাল ঠাকুরের কোনো সম্পর্ক আছে কি না আমার জানা নেই। একটি বিশ্বাস ছিল যে হাতিকে সম্মান করলে হাতি কখনোই আক্রমণ করে না। আমাদের শেখানো হত, মহাকালের অনেক বড়ো কান, সে অনেক দূর থেকে সব শুনতে পায় ও মনে রাখে দীর্ঘদিন। তাই তাকে হাতি বলা যাবে না, মহাকাল বলতে হবে।
সেই জাকিরুল ভাইয়ার শ্বশুরবাড়িতে গরুর মাংস, ভাত তো খাওয়ানো হয়েছিল, তার সাথে দিয়েছিল কলিজার দো-পেঁয়াজি আর টমেটোর চাটনি। তখন বিয়েবাড়িতে গরুর মাংস, ডাল আর ভাত—এইসব খাওয়ানো হত সাধারণত। কলিজার দো-পেঁয়াজি আর চাটনি খাইয়েছিল বলে আমার মনে সেই বউ আর তার পরিবার সম্পর্কে এক আলাদা কদর জন্মেছিল।
সেই বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই জাকিরুলের বউকে পেত্মানি ধরেছে বলে চাউর হল। মুনশি, মওলানা আর ওঝা সব ডাকা হল। সব তেল ফুঁক দিয়ে দেয়, জল ফুঁক দিয়ে দেয় কিন্তু কেউ আর পেত্মানিকে বের করতে পারে না। জাকিরুল সারারাত ধরে তার উপর যে অত্যাচার করত তার ফিরিস্তি দিত সে সারাদিন বসে বসে। যেভাবে তাকে রাতের পর রাত বারবার স্বামীর অকথ্য, অমানবিক ও হিংস্র চাহিদা মেটাতে হত সেগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা সে দিত।
আশেপাশের লোকজন তারপর হাল ছেড়ে দিল, এই অবস্থায় সে চারটে বাচ্চার মা হল। সে তিন দিন ঠিক থাকে, চার দিন আবার সে বকে। কেউ আর তাবিজ নিতে ছোটে না তার জন্য। অবহেলায় আর সারারাতের সেই অত্যাচারে সে এখন রুগ্‌ণ হতে হতে দাঁড়িয়ে থাকা এক থোক পাটকাঠি মনে হয়…

একটু বড়ো হওয়ার পর জানতে পারলাম যাঁরা প্রশ্ন করে, তারাই পেত্নি বা পেত্মানি।
যাঁরা নিয়ম ভাঙে তারাই পেত্মানি। যাঁরা পরিবারে অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায় তারাই পেত্মানি।
বাড়িতে যখন আমার প্রথম প্রেমের কথা জানতে পেরেছিল বা আমার স্বামীর সাথে আমার সম্পর্কের কথা, দুই ক্ষেত্রেই আমার চুলের মুঠি ধরে ঘোরাতে ঘোরাতে মা জোরে জোরে বলছিল—“পেত্মানি ধইরছে পেত্মানি! প্রেম করিব, ভালোবাসা করিব, সব ভালোবাসা তোর ছোটে দিম!”
তারপর ডিভোর্সের পর, একদিন টিচার্স রুমে এক সহকর্মী গল্প করতে করতে অন্য আরেকজন মহিলাকে আমার সাথে তুলনা করতে গিয়ে আমাকে বলছিলেন,
“ওই মহিলাটি আপনার থেকেও খতরনাক!” ফ্রয়েডিয় স্লিপ বা ইচ্ছে করে বলা এই কথার মধ্যেই নিহিত আছে পিতৃতন্ত্রের ফরমুলার বাইরে থাকা মহিলারা। আমাদের মতন পিতৃতন্ত্র-র খাপে খাপ না-বসা মহিলাদের সুযোগ বুঝে পেত্মানি, খতরনাক, পাগল বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। সমাজ, রাষ্ট, পরিবার সবাই এই “পেত্মানি” নির্মাণ করার প্রক্রিয়ায় যুক্ত। এতে পিতৃতন্ত্রের সকল মেকানিজম-এর সুবিধে—“অবাধ্য,” “বেহায়া” উৎসুক নারীদের প্রশ্ন করা থেকে বিরত রাখা যায়। ছেঁটে ফেলা যায়। চিকিৎসা করার যা খরচ সেই দায়িত্ব থেকে রেহাই পাওয়া যায়।

কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’

আমার দাদু (ঠাকুরদা) ছয় খানা বিয়ে করেছিলেন। আমার নিজের দাদি ছিল পাঁচ নম্বরে। আমি আমার নানির বাড়িতে বড়ো হয়েছি, তাই দাদি যাকে বু বলে ডাকতাম তাকে জানার বোঝার সুযোগ হয়নি। বু-এর কথা মনে পড়লেই মনে পড়ে একটি স্মৃতি কেবল—ফ্যালফ্যাল চোখে বু তাকিয়ে থাকত আর বু-এর মাথা গা জুড়ে ঘৃতকুমারী তেলের গন্ধ। সবাই ধরে নিয়েছিল বু-কে জিনে ধরেছে। মহিলা জিন। বু পরিবারের সব কাজেই ব্রাত্য ছিল। আলাদা করে দেওয়া থালা আর গ্লাস নিয়ে বু যেন ফ্যালফ্যাল চোখে উত্তর মেলাতে চাইত। ব্যর্থ হয়ে বু একদিন একটা নতুন কবর হয়ে গেল আর তার কবরের আশেপাশে আপনার মনে জন্মে গেল কিছু নয়নতারা ফুলের গাছ। যখন সন্ধেবেলা ঝুপ করে সন্ধে নামে, বাঁশ বাগানের পেটে আসন্ন রাতের আবছা অন্ধকার বুকে নিয়ে কবরটা জেগে ওঠে। আমি ঘৃতকুমারী তেলের গন্ধ পাই। আর স্বপ্ন দেখি কোনো একদিন বাঁশগাছগুলোর গভীরতম ছায়ায় আমি মিলিয়ে যাব। পৃথিবীর সব পেত্মানিদের সাথে জুড়ে দখল নেব পৃথিবীর। পৃথিবীর মানুষদের গা জুড়ে বড্ড পুরুষ পুরুষ গন্ধ, যে গন্ধে গা গুলিয়ে ওঠে আর তেতো তেতো পিত্তরস মুখের ভিতরটা বিষিয়ে দিয়ে চারপাশ কেমন ধোঁয়াটে ঢেঁকুর ওঠা গন্ধে ভরে থাকে সারাক্ষণ। আমি হয়তো সেই বাঁশঝাড়গুলোর ভিতরে পাব আমার অনেক নানিদের যাঁদের বয়স হয়ে গিয়েছিল বলে অবহেলায় মৃত্যুর কাছে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল বা বাড়ির পেত্মানি বলে বাড়ির সব অমঙ্গলের বোঝা তাঁদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিল সুশীল পরিবার।
ফাশিরডাঙ্গার বাঁশঝাড়, উত্তরবাড়ির পুকুরপাড়ের বাঁশঝাড় কিংবা জলিল মিস্ত্রির বাড়ির পাশের বাঁশ ঝাড়গুলোতে, সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আমি পা বাড়াই। শুধুই নয়নতারা ফুল চারিদিকে। অমানুষ মানুষের বাস যাঁদের মাড়িয়ে যেতে পারেনি এখনও। পৃথিবীর সব পেত্মানিদের নিয়ে মাঝরাতে আমি দখল নিই পৃথিবীর আর চিৎকার করে বলি:

ডাইনি শিকার
আমিই সেই ডাইনি, আমি ঝোপে থাকি না। আমি থাকি তোমাদের বাড়িতে আর খুব বেশি প্রশ্ন করি।
তোমরা আমায় শিকার করো বিছানায়, খাপ পঞ্চায়েতে, রান্নাঘরে, আর ফিল্‌মের সেলুলয়েডে। তোমরা আমার জিভকে দোষ দাও সব কিছুর জন্য, আমি কোনো ঝোপঝাড়ে থাকি না
থাকি তোমাদের শোয়ার ঘরের বিছানায়
আমিই সেই ডাইনি, তোমরা আমায় বশ করতে পারবে না।
তোমরা আমায় শিকার করো কর্মক্ষেত্রে, বেশ্যা, দুশ্চরিত্রা বলে গাল দিয়ে।
আমিই সেই ডাইনি যাকে তোমরা ভয় পাও। তোমরা আমায় সর্বত্র পিটিয়ে মারো
আমিই সেই ডাইনি, তোমরা আমায় বশে আনার জন্য বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেছ
তোমরা চাও বাধ্যতা, আর আমি চাই আমার প্রাপ্য ভাগ।
আমি ঝোপের ডাইনি নই, আমি থাকি তোমাদের ডাইনিং রুমে।
(মূল কবিতা Witch Hunt-এর ভাবানুবাদ)


কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই,ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন


এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।

লেখক

মৌমিতা আলম একজন কবি, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার। উত্তরবঙ্গে বাড়ি, উত্তরবঙ্গের মাটির কথা লেখেন। ২০২৫ সালে উত্তরবঙ্গ সংবাদের বিচারে উত্তরের সেরা প্রাবন্ধিক সম্মান পেয়েছেন। ইংরেজিতে প্রকাশিত তাঁর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা তিনটি। তাঁর কবিতা ভারতবর্ষের ১৭টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর লেখা কবিতার পূর্ণ কবিতা সংগ্রহ প্রকাশিত হয়েছে তামিল, তেলেগু ও হিন্দি ভাষায়। তিনি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, আউটলুক, দ্য ওয়ার এর জন্য প্রায়শই লেখেন।

অন্যান্য লেখা