প্রকাশিত হল সুমন জানার কবিতাগুচ্ছ ‘পিঞ্জর ও অন্যান্য’। পাচঁটি কবিতা এই গুচ্ছ কবিতায় স্থান পেয়েছে--‘পিঞ্জর’, ‘আমার কল্পনাশক্তি’, ‘বিকল্প’, ‘ফিরতি পথ’ এবং ‘আম্রপালী’।
পিঞ্জর
আর লিখছি না বিকেলের রোদ। লিখলেই
আকাশ কালো করে মেঘ ঢেকে আসছে,
কবিতার পঙ্ক্তি থেকে শব্দগুলো
ঝুপ ঝুপ লাফ দিয়ে পড়ছে রাস্তার জলে।
‘সাঁতার জানে না তো, ডুবে যাবে,
রাস্তা তো তোমার-আমার একার নয়, নর্দমারও’, বলে
নোংরা জল থেকে শব্দগুলোকে তুলে আনতে
আমাকেও লিখতে হচ্ছে ছাতা, লিখতে হচ্ছে
কাগজের নৌকো, ভেসে যাওয়া একপাটি চটি।
ছাতা সারানোর মিস্ত্রির খোঁজে শনিবারে শনিবারে
সাইকেল ঠেঙিয়ে ছুটতে হচ্ছে পোস্টাপিস মোড়।
পোস্টাপিস লিখলেই অনেক দিন আগের
অর্ধেক লেখা কবিতাটা খামে ভেসে চলে যেতে চাইছে
দূর মফস্সলের কোনো তরুণীর বাড়ি।
‘লজ্জা করে না! বয়সের গাছপাথর নেই!’ বলে
আবার তাকে জোর করে ধরে এনে
বসিয়ে দিতে হচ্ছে ডায়েরির পাতায়, তার আগে
কথা দিতে হচ্ছে এবারে তাকে সম্পূর্ণতা দেওয়া হবে।
দিচ্ছি। তবে সেই অর্ধে আর লিখছি না বিকেলের রোদ,
মেঘ, নর্দমার জল, কাগজের নৌকো, ভেসে যাওয়া চটি।
ছাতা সারানো মিস্ত্রির ঠোঁটে ঝুলে থাকা আধপোড়া বিড়িও লিখছি না।
মফস্সলের তরুণীরা ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াক
সরষে খেতের পাশে, আর তাদের
আমার লেখায় এনে বিরক্তও করছি না।
বিদ্যুৎ চলে যাওয়া এই রাতের অন্ধকারে
কেবল শব্দগুলোর ঘাড় ধরে ঢুকিয়ে দিচ্ছি
মুক্তছন্দের ছোটো ছোটো ফাঁকগুলো দিয়ে।
বাইরে পড়ে থাকুক তাদের ডানার ঝটপটানি,
পালকের রোম। আর আমি বলাকা লিখছি না…
আমার কল্পনাশক্তি
বহু ব্যবহারে আমার কল্পনাশক্তির গায়ে ময়লা জমেছে,
তাকে কলপাড়ে নিয়ে যাই। সারাটা সকাল
চুবিয়ে রাখি সাবান গোলানো জলে,
যাতে বেশ রগড়ে রগড়ে ধুয়ে
দুপুরের রোদে মেলে দেওয়া যায়,
অনেকদিন পরে আজ ভালো রোদ উঠেছে।
স্নানের আগে তাকে ধুতে গিয়ে দেখি
সাবানের পিচ্ছিলতা আমার কল্পনাশক্তিকেও
পিচ্ছিল করেছে। যা কিছু ধরতে যাই,
নাম, যশ, গোপন সম্পর্ক, সবকিছু
কবিতার পঙ্ক্তির মতো স্যাঁৎ করে
হাত থেকে পিছলে চলে যায়।
সাবান ধোয়ার জন্য যত জল ঢালি
তত ফেনা ওঠে। ফেনায় ফেনায় ঢেকে
কল্পনার সেলাই খুলে শক্তি যে কখন
ধুয়ে বেরিয়ে গেছে পৌরসভার নর্দমায়,
আমি সারা বিকেল খুঁজেও তার সন্ধান পাইনি।
শক্তিহীন এই কল্পনাটিকে নিয়ে
এখন আমি কী করি?
কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
বিকল্প
তোমাকে মন্দির চাতালে বসাবার আগে
হাত দিয়ে সরিয়ে দিই শুকনো ফুল পাতা।
তোমাকে নদীর পাড়ে বসাবার আগে
ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিই ধুলো।
তোমাকে নৌকোর খোলে বসাবার আগে
রুমাল দিয়ে মুছে দিই ছলকে ওঠা জল।
কতদিন ধরে তুমি হেঁটে চলেছ আমার সঙ্গে
এখন তোমারও কিছুটা বিশ্রামের প্রয়োজন।
মন্দির চাতালে যদি ভিড় থাকে খুব,
নদীর দু-পাড় যদি ডুবে যায় জলে,
আমরা পৌঁছোনোর আগে সব নৌকো ছেড়ে দেয়,
তোমাকে আমার লেখার মধ্যে বসাবার আগে
কলমের খোঁচা দিয়ে খুলে নিই
দু-একটা আলগা অক্ষর…
ফিরতি পথ
আমার লেখার থেকে দূরে সেই ঠাকুর মন্দির।
ঠাকুর মন্দির, না কি তোমাদের গাঁয়ের ইস্কুল?
টালির ছাউনি দেওয়া বাড়িটির মাটির দেওয়ালে
দুষ্টু ছেলেদের মতো বর্ষা তার নাম লিখে গেছে—
বৃষ্টি এসে গেল বলে তার নীচে বাইক থেকে নামি।
তখন বিকেল শেষে তোমার যে ছাগলছানাটি
ফেরত আসেনি, তুমি তার খোঁজে ভিজতে ভিজতে
দৌড়ে গেছ পুকুরের পাড়ে যত, দৌড়ে গেছ মাঠে,
বৃষ্টির ফোঁটারা খুব মজা পেয়ে হল্লা করে তাকে
ততই তাড়িয়ে নিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছে সেই মাটির রোয়াকে।
এতক্ষণ একটানা ছুটে ছুটে তুমিও না পেরে
কেয়া ঝোপটির পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে গিয়েছ
ভেজা এক বাবলা গাছের মতো ঝুঁকে।
বৃষ্টি থেমে গেছে দেখে আজ আমি এতদিন পরে
সেইসব মন্দির বা স্কুলের রোয়াক থেকে নামি।
কেয়া ঝোপটির পাশে নীরবে নামিয়ে দিয়ে আসি
আমার লেখার মধ্যে ভিজে একশা হয়ে বসে থাকা
তোমার হারিয়ে যাওয়া ছাগলছানাটি।
আম্রপালী
এটা কি গোলাপখাস? আর ওটা আম্রপালী বুঝি?
যত আমগাছ তত ছায়া ছায়া অন্ধকার ঘর।
এমন কতই আম পড়ে পড়ে নষ্ট হয়, তবে
দরজা দিতে হল কেন? কেউ কিছু মনে করে যদি!
কতদিন পরে দেখা, সত্যিই কি চিনতে পারোনি?
দোতলার যে ঘরটায় তখন থাকতাম তুমি তার
জানালায় হাত বাড়িয়ে আম নয়, মুঠো মুঠো চাঁদ পাড়ছিলে,
হিমসাগরের মতো ঠান্ডা চাঁদ, ভয়ে কাঠ হয়ে গেছি আমি।
তোমার নদীর স্রোত ভিজিয়ে গিয়েছে শুধু, সে কাঠ ভাসায়নি।
আজ এতদিন পরে মৃত সেই কাঠের শরীরে
তুমি কি জোনাকি খোঁজো? না কি তাকে দিতে এলে ফের
তেমনই গোলাপখাস? ন্যাকা আম্রপালী?
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই,ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
মন্তব্য করুন