preloader
বাংলা বইয়ের e-ভুবন
Menu Categories Search Cart 0
Menu
Cart

Total 0 Items

☹ Your cart is empty

Sub Total:

$0

₹0

বিভাগ
মাছ-সুমারি
গল্প

মাছ-সুমারি

কণাদ মুখার্জির ‘মাছ-সুমারি’—এক নিঃশব্দ মানবিকতার গল্প। কুয়াশা ঢাকা ভোর, মাছ ধরা পুকুর, আর সতীশ নামের এক সাধারণ মানুষের অচেনা করুণায় জীবনের গভীরতা ফুটে ওঠে। প্রকৃতির নিস্তব্ধতার ভেতর মানবতার নরম আলো ছড়িয়ে যায় এই অনবদ্য গল্পে।

শীত একটু একটু করে পড়ছে। এখন সারা দিন আকাশ কেমন ঘোলাটে হয়ে থাকে। খুব ভোরে উঠলে দেখা যায় আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশার চাদরটার রং ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে। সরবতের বরফ থেকে বার হওয়া ধোঁয়ার রং যেমন, ঠিক তেমন রঙের চাদর। আবার সাতটার দিকে ঘড়ির কাঁটা গড়ালেই কুয়াশা উধাও হতে থাকে। যেন কিছুই হয়নি এতক্ষণ। অথচ এই সময়ের কুয়াশা ফাঁকা মাঠের মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া পাকা রাস্তায় কতটা ভয়াবহ তা জানে সতীশ। ওই সাদা চাদর মানুষকে ঘিরে ধরে, বিভ্রম তৈরি করে জীবনের ঘূর্ণির মতো। ঠিক দু-দিন আগেই করাতকল মোড়ের কাছে একটা ম্যাটাডর উলটে গিয়েছিল রাস্তার বাঁ-দিকের ধান জমিতে। ড্রাইভারের কিছু হয়নি বটে। কপাল জোরে বেঁচে যায়। গাড়ির গতি কম ছিল। গাড়ি উলটে যাওয়ার মুহূর্তে ডান দিকের দরজা খুলে ঝাঁপ দিতে পেরেছিল রাস্তার উপরে। সকালের ফার্স্ট গাড়ি, গ্যারাজ থেকে সদ্য বার হয়েছে তখন। সেই সময় খালাসি ছিল না। থাকলে একটা মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী ছিল। অ্যাক্সিডেন্টের সময় বাঁচার জন্য চালকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রায় কোনো খালাসিরই বাঁ-দিকের দরজা খোলা হয়ে ওঠে না। স্টিয়ারিংয়ে কারও হাত নেই দেখতে দেখতে খালাসিরা চলে যায় চিরন্তন অন্ধকারের স্রোতের দিকে। সে-দিন একটু থিতু হওয়ার পর পানুর চায়ের দোকানে এক কাপ চা খেতে খেতে এসবই শোনাচ্ছিল ম্যাটাডরের চালকটা। পানুর দোকানেই একটা বিড়ি ধরিয়ে খুব মন দিয়ে সেইসব বিবরণ গ্রাস করে নিয়েছিল সতীশ। একটা মানুষের মৃত্যুর মুহূর্তের এমন ধারাবিবরণী কখনও শোনা হয়নি তার।

এমনই ধোঁয়া ধোঁয়া ভোরে একদিন খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছা করে সতীশের। পাকা রাস্তায় ওঠার জন্য সরু মাটির রাস্তা পেরিয়ে পিচ সড়ক ধরে বহু দূরের কোনো গ্রামে যেতে ইচ্ছা করে তার। যে গ্রামে যেতে যেতে ভোর পার হয়ে সূর্য উঠে যাবে। গায়ে জড়ানো পাতলা সূতির চাদরটায় পিছন থেকে হালকা রোদ পড়বে। ঘাড়ের কাছটায়, যেখানে জামার কলারটা বাঁশ গাছের গিঁটে আটকে গিয়ে নেমে গিয়েছিল আগেই, তার ঠিক উপরের অংশটা বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটু একটু করে গরম হয়ে উঠবে। একসময় চাদরটা গা থেকে নামিয়ে কোমরে বেঁধে নিতে হবে। তারপর মোরামের রাস্তা পার হয়ে লাল ধুলোয় মাখামাখি পায়ে নতুন কোনো গ্রামে ঢুকবে সতীশ বিড়ির ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে। ঠিক যেন ছোটোবেলায় দেখা স্টিম ইঞ্জিন।

কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’

এই ভোরের সময়টা খুব ভাল লাগে সতীশের। এই সময় সব কিছুই কাঁচা মনে হয় তার। সূর্যের আলোর রং কাঁচা। বেলা হলে তাতে পাক ধরবে। উষ্ণতা বাড়বে। ফুল, ফল সব কাঁচা, কচি মনে হয় তার। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে পেঁয়াজকলির ফুলের রং ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায় কুয়াশার চাদরে। গাঁ, পাড়া সহ কিছু একটু একটু করে জাগতে শুরু করে। পথে পায়ের শব্দের ভিড় বাড়ে ধীরে ধীরে। এই সময় দর্শকের মতো সব কিছু লক্ষ করে যায় সতীশ। কেউ ওকে কিছু বলে না। ও-ও কাউকে কোনো কথা শুধায় না। পানু শুধু এক কাপ দুধ চা এগিয়ে দেয় ওর দিকে। সতীশ নিঃশব্দে চা শেষ করে চারপাশ দেখতে দেখতে। তারপর গরম চায়ের ওমটা দু-হাতে কয়েক বার ঘষে নিয়ে পকেট থেকে বিড়ির তারা বার করে। একটা বিড়ি বার করে খুব ভালো করে নিরীক্ষণ করতে থাকে। গায়ে লেগে থাকা লাল সুতোর রোঁয়া পরম মমতায় সরিয়ে দেয়। এরপর তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের মাঝে বিড়িটা রেখে সতীশ অনুপান মতো ডলে নেয়, যেমন আর পাঁচজন করে। তারপর দাঁতে চেপে ধরে বিড়ি ধরায়। চায়ের দোকানে সেই সময়ে জড়ো হওয়া সকলের গল্প শোনে কান পেতে।

হেমন্তের এমন ভোরে পুকুরের জল কনকনে ঠান্ডা হওয়ার সুযোগ পায় না। তবে নামলে প্রথম দিকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। দিনের শুরুতে চামড়ার সঙ্গে জলের প্রথম স্পর্শের মধ্যে একটু উত্তেজনা আছে। জেলেরা সেটা উপভোগ করে। তা ওদের কথাবার্তায় টের পায় সতীশ। এই সময়টায় পুকুরে জলের স্তর নেমে আসে। জলে জাল নামালে এক দল মাছ পাঁকের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে। পাকা জেলে হলে পাঁকে মাথা গুঁজে থাকা সেই কালচে মাছ হাতে ধরেই কোঁচড়ে জমিয়ে রাখে। নাহলে ওই মাছ ধরা যাবে না। তবে তার উপরে স্তরে যেসব রুপোলি মাছ ঘোরাফেরা করে তারা তাদের মাপমতো ঢুকে যায় জালের ফাঁদে। আর বার হতে পারে না। পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে সতীশ জাল টেনে পাড়ে তোলার সময় মাছের ছটফটানি দেখতে পায়। অল্প জল রেখে একটা-দুটো করে অনেক মাছ একসঙ্গে হাঁড়িতে ভরে দেওয়া হয়, গাদাগাদি করে। পুকুরের পাড়ে রাখা হাঁড়ির অল্প জলে কয়েকটা মাছ লাফায়। কেউ কেউ দিশাহীন লাফ দেয়। জেলেরা সচকিত হয়ে হাঁড়ির বাইরে চলে আসা মাছ আবার মুঠো পাকিয়ে ধরে ভিতরে চালান করে দেয়। এই ভোরে সতীশের এসব ভালো লাগে না। পুকুর পাড়ে মাছের হাঁড়ি ঘিরে জমে থাকা ভিড়ের মধ্যে দিয়ে ও হাত চালিয়ে দেয়। হাঁড়ি থেকে দুটো মাছ সরিয়ে লুকিয়ে নেয় চাদরের মধ্যে। তারপর হাঁটা দেয় দ্রুত।

এসবের মধ্যেই রোদ উঠে যায়। সূর্য তখন পূর্ব থেকে পশ্চিম অর্ধবৃত্ত পথে এগিয়েছে অল্প। কাটোয়া থেকে সাহেবতলা আসতে লোকাল ট্রেন যতটা সময় নেয়, ঠিক ততটাই। সতীশের হাতের মুঠোয় মাছদুটো খলবল করে ওঠে কয়েক বার। যেন এই শেষ বার। এবার সতর্ক হয়ে ওঠে সতীশ। পুকুরের অপর পাড়ে সে ততক্ষণে পৌঁছে গিয়েছে। মাছদুটোকে ফের পুকুরে ছুড়ে দেয় সে। তারাও জলের স্পর্শ পেয়ে মুহূর্তে বিলীন হয়ে যায় পুকুরের কালো তরলের গর্ভে। তার পর একেবারে পিছন দিকে ঘুরে মুখে পড়ে থাকা সকাল ছ-টার ঈষদুষ্ণ রোদটা রুমালের মতো ঘাড়ে ফেলে নিয়ে রওনা দেয় মোরামের লাল পথ ধরে।

প্রত্যেক বার মাছ ধরার সময় অন্য পাড়ে ঘটে যাওয়া এই দৃশ্যটা চোখ এড়ায় না পুকুর মালিকের। হাতে শেষ হয়ে যাওয়া চায়ের কাপ আর জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে মনে মনে হেসে ওঠেন তিনি। মাছ আড়তে পাঠানোর পর, কত পিস কাতলা, বোয়াল এবং পাঙাশ পুকুরে রইল তা নিয়ে আলোচনা করতে থাকেন হেড জেলের সঙ্গে। দুটো কাতলার খোঁজ মিলছিল না। সতীশের জীবনদানের দৃশ্যটা দেখার পর পুকুরে থাকা মাছের সুমারি চলাকালীন সেই নিখোঁজ কাতলাদুটো মনে মনে জুড়ে নেন সিগারেট-বাবু।


কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই,ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন


এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।

লেখক

কণাদ মুখার্জি, জন্ম: ১৯৭৯, শিক্ষা: বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়, প্রথমে ইংরেজি ভাষা ও পরবর্তীকালে সাংবাদিকতার ছাত্র। পেশায় সাংবাদিক। গ্রামের মানুষ। শহরে পেটের দায়ে আসা। মূলত ফেসবুকে লেখালিখি। গল্প লেখা এই প্রথম।

অন্যান্য লেখা