এ ঠিক ভ্রমণ কাহিনি নয়। বরং বলা যায় এ এক আখ্যান যা মানুষের স্বভাবজাত আবেগকে প্রশ্রয় দেয়। তাই আমার চোখে সে দেশ যেভাবে ধরা দিয়েছে, সেটাই আমি ভাগ করে নেব সবার সাথে।
T.G 624 নিনয় অ্যাকুইনো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করা মাত্রই প্রিয় মুখটা দেখার জন্য মন ছটফট করে উঠল। কিন্তু লাগেজে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগবে। চার নম্বর গেট দিয়ে বেরোলাম যখন, সন্ধে হয়ে গেছে। ব্রত নিতে এসেছে। বেশ কিছুক্ষণ জড়িয়ে থেকে ভেতরে ভরে নিলাম গন্ধ…
আজ দশ বছর হল ও ঘর ছেড়ে এখানে। ওর বাড়ি কিন্তু প্রপার মানিলায় নয়। ওর শহর মানটিনলিউপা। এখানে প্রভিন্সের ভাগাভাগি একটু অন্যরকম। এদের ভাষায় প্রোবিন্সিয়া বা লালাউইগান। গাড়ি চলেছে মেট্রোম্যানিলার ট্রাফিকবহুল রাস্তায়। এখানে দেখলাম ইংরেজি বানান সব শর্টকাট। যেমন THRU TH TANL অর্থাৎ থ্রু দ্য টানেল। এদের মতে, সাইনবোর্ড দূর থেকে দেখে বোঝার জন্য। সেখানে অযথা বানানের জটিলতায় অনেক বড়ো শব্দ লিখলে, অক্ষর ছোটো ছোটো হবে। দেখা যাবে না। মনে পড়ল, ছোটোবেলায় বাবার আর আমার একটা প্রিয় খেলা ছিল, ভোরবেলায় সাইকেলে চড়ে সদ্য ঘুমভাঙা ছোট্ট শহরে একটা চক্রাকারে টহল দেওয়া। যেতে যেতে সাইনবোর্ড দেখলেই বলতেন, ‘পড়’! বলতেন, কিন্তু দাঁড়াতেন না। চলন্ত সাইকেল থেকে সঠিক উচ্চারণে পড়তে হত। সেই অভ্যাসে বড়ো হওয়া আমি, চোখে লাগে এসব। অবশ্য সব কিছুকেই একদিন না একদিন পালটাতে হয়।
কিছুক্ষণ পরেই গাড়ি সত্যিই একটা ছোটো টানেলের মধ্যে ঢুকে গেল। বেরিয়ে প্রায় নব্বই ডিগ্রি বাঁক নিল, সঙ্গে সঙ্গে ম্যাজিকের মতো দৃশ্যপট পালটে গেল! রাস্তাটা অপেক্ষাকৃত সরু। দেখলাম লেখা রয়েছে ‘বাইপাস টু ম্যানিলা’! দু-পাশে গাছের ঢাল নেমে গেছে, থরে থরে। অর্থাৎ রাস্তাটা উঁচু হচ্ছে ক্রমশ। কলাগাছ দেখলাম সারি সারি। এ ছাড়াও প্রচুর তেঁতুল গাছ। আরও কতশত গাছ রাস্তাকে ওপর দিকে থেকে ছেয়ে ফেলে দিব্যি একটা গাছের টানেল বানিয়ে ফেলেছে। মনে হচ্ছে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলেছি। হঠাৎ হঠাৎ জঙ্গল ভেদ করে গজিয়ে উঠেছে লোকালিটি। বেশ ছোটো কিন্তু আধুনিক সব বাড়িঘর। এখানে দেখলাম খাবার পাওয়া যায় যত্রতত্র। বাড়ির লোকেরা মিলে ঝিকিমিকি আলোর রেস্টুরেন্ট সাজিয়ে বসেছে। আজ রাত হয়ে গেছে। দু-পাশের কালচে জঙ্গল পেরিয়ে বেশ খানিকটা নেমে এলাম। আবার হাইওয়ে, এবার চোখে পড়ল বিশাল উঁচু উঁচু শপিং মল। কত তলা কে জানে! ‘ভিল্লার সিটি’ লেখা রয়েছে বিশাল অক্ষরে। কিন্তু গাছপালার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেনি রাস্তা । হাইওয়ে ছেড়ে ‘গ্রিন হাইট’ হাউসিং-এ ঢুকল গাড়ি। সুপরিকল্পিত পরিচ্ছন্ন হাউসিং। রাস্তাগুলো ফুলের নামে। ইয়োলোবেল, রোজমেরি, ম্যাগনোলিয়া হিবিসকাস। ব্রতর বাড়ির রাস্তার নাম কোয়ার্কাস স্ট্রিট। একুশ নম্বর দরজায় এসে দাঁড়াল। রাত তখন সাড়ে আটটা। ব্রত আর লিজা আমায় দু-টি ছোট্ট ছোট্ট রাজপুত্তুর উপহার দিয়েছে। তারা রোদ আর মেঘ। এতদিন আমায় ভিডিয়ো কলে দেখে দেখে চিনে গেছে, সহজেই ভাব হয়ে গেল। আজ ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। পুত্রবধূ লিজা এদেশের মেয়ে, কিছু রান্না ভীষণ ভালো করে। ওর দেশে এসেছি, তাই ও সিনিগাং আর মাছ ভাজা করে রেখেছে। সঙ্গে সুগন্ধি ভাত। সিনিগাং এক ধরনের স্যুপ জাতীয় জিনিস। কিন্তু দেখে মনে হয় সব কিছু কাঁচা। অর্থাৎ সমস্ত সবজির রং একই থাকে। এখানে হলুদ ব্যবহার হয় না। মশলা হিসেবে ব্যবহার হয় রংহীন নানারকম সস, তাই সম্পূর্ণ স্বাভাবিক রং বজায় থাকে আর খেতেও ভীষণ ভালো। সেদিন পেটপুরে খেয়ে ঘুম…
সব বাড়ির সামনে বাগান রাখতেই হবে এখানে। তাই রাস্তার দু-ধারে ছোটো-বড়ো অজস্র গাছ, বড়ো দৃষ্টিনন্দন। সকালে উঠে কালো মসৃণ রাস্তায় হাঁটতে বেশ লাগে। একটা বাড়ির বাগান টগর আর রজনীগন্ধা দিয়ে সাজানো। আরেকটায় দেখলাম অজস্র রঙের ছোটো ছোটো ফুল, অনেকটা নয়নতারার মতো দেখতে। নতুন গড়ে উঠছে এই হাউসিং, ফাঁকা জায়গা প্রচুর। ফিলিপিন্স ভৌগলিক অবস্থানে নিরক্ষীয় বৃষ্টি অরণ্য অঞ্চল, কালটিও বর্ষা, অতএব চারিদিকে চোখজুড়োনো সজল-শ্যামলিমা, পাখির কলরব… রাস্তার একেবারে কোণে যে-বাড়িটা রয়েছে, সেখানে একটি ফুটফুটে মেয়ে, এমেল থাকে। ওর সাথে আলাপ হল। ওর বাবা ফুড সাপ্লায়ার, বাড়ির সামনে ছোট্ট একটা ব্রেকফাস্ট কাউন্টার । সেখানে হটগড, চকোব্রেড, বয়েলড এগ, প্যানকেক ছাড়াও হট কফি, কোল্ড কফি, আইস টি, নানারকম ফ্লেভারের চায়ের বেশ ভালো ব্যবস্থা, এটা ওর মা চালান। আলাপ হল তাঁর সাথেও। এদের ব্যবহার ভীষণ সপ্রতিভ। চেনা অচেনা সবাইকে হাসিমুখে গুড মর্নিং বলা এদের সংস্কৃতির অঙ্গ। এখানে সর্বত্র আমগাছের রাজত্ব। এমেলদের বাড়ির দুইপাশে দুটো বিশাল আমগাছ। অজস্র আম ঝুলছে। আগেই বলেছি এখন ঘোর বর্ষা, বোঝা যাচ্ছে, আম এখানে সারাবছর ফলে। ব্রতর বাড়ির সামনে, পিছনে পাতাবাহারি গাছের বাগান। সারাদিন দেখে দেখে আশ মেটে না। এক ধরনের পাতা দেখলাম, মেরুন রঙের । ওরকম পাতা দেখিনি কখনো। সমস্ত প্ল্যানড হাউসিং-এর একটা সমস্যা আমায় বেশ অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। সেটা হল, সব রাস্তাই একরকম। বাড়ি, বাগান, সাইনবোর্ড লক্ষ রেখে চলতে হয়, নাহলে বিপথগামী হওয়ার সমূহ সম্ভবনা। অতএব মুগ্ধ হয়ে গাছের সঙ্গে নিভৃত প্রেমালাপে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ‘হারিয়ে যাওয়ার ভয়’। আমি এই বিড়ম্বনা থেকে বাঁচার জন্য এক এক দিনে দু-টি করে রাস্তা বেছে নিই। অনেক রাতে, যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, আমার অভিসার চলে গাছেদের সঙ্গে।
কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
একদিন এরকমই বেরিয়েছি। একটা মস্ত সোনার আয়নার মতো চাঁদ আকাশে। সোনার গুঁড়ো ছড়িয়ে দিচ্ছে শিশির ভেজা পাতায় পাতায়। স্ট্রিট লাইটের আলো বৃথাই চেষ্টা করছে তাকে আটকানোর। আমার বেছে নেওয়া রাস্তাদুটো যে-মোড়ে ভাব করেছে, তার ঠিক সামনেই একটা কলা আর আমগাছের বাগান। রাস্তার ধারগুলো একটু উঁচু করে বাঁধানো। সেখানে কেউ বসে আছে, সোনার গুঁড়ো তার চুলেও । একটি মেয়ে। তার হাতে খাতা আর পেনসিল। লক্ষ করলাম, পাশেও রাখা রয়েছে একগুচ্ছ পেনসিল। ঠিক শিল্পীদের যেমন থাকে। ভাবছি, যাব কাছে? ব্রত বলছিল, এরা নাকি ব্যক্তিগত আলাপকে খুব একটা ভালো চোখে দেখে না। আমি আবার ভিনদেশি। ইতস্তত করছি, মেয়েটি মুখ তুলে হাসল। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। আমার কেমন যেন অস্বস্তি লাগল। একটু হেসে চলে আসছি, বলল ‘হ্যালো ম্যাম! আর ইউ ফ্রম?’
আমি এবার স্বচ্ছন্দে বললাম, ‘ফ্রম ইন্ডিয়া!’ আশ্চর্য, ও কিন্তু জানতে চাইল না, আমি এখানে কোথায় এসেছি। বলল, ‘এম রেদেনা ডিস্যুজা। এন আর্টিস্ট! উড ইউ লাইক টু বি মাই মডেল?’
আমি সম্মতি জানাই। আমাকে একটা গাছের তলায় দাঁড় করিয়ে দিল। হেসে দু-হাতের দশটা আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘টেন মিনিটস্! স্মাইল…!’
আমি বুঝিয়ে দিলাম, যখন মুখ আঁকবে বোলো! দশ মিনিট ধরে মেকি হাসি কন্ট্রোল করতে পারব না। ও ঘাড় নাড়ল, পেনসিল চলল খসখস শব্দে। আমি স্থির দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ মনে হল, আরে আমার কাছে তো টাকাপয়সা নেই! যদি চায়! হাত দেখিয়ে থামতে বলি। ‘আই হ্যাভ নো মানি রাইট নাউ!’
‘নো নো! নো ফ্যাক্টর! আই এ্যাম আ স্টুডেন্ট! এন্ড ইট ইজ় ফর মাই প্রোজেক্ট!’
আমি খুশি হয়ে এবার সত্যিই স্মাইল দিলাম। দশ মিনিট হল কি না জানি না, আমার মনে হল অনন্তকাল দাঁড়িয়ে আছি। কীকরে লোকে মডেলিং করে, কে জানে বাবা! আমায় কয়েকটা মশা কমড়ে দিল। বেশ জঙ্গল এখানে। যাইহোক, একসময় আঁকা শেষ হল। দেখলাম, অসাধারণ স্কেচ করেছে মেয়ে। সে-কথা বলতে আমার আঙুল ধরে কপালে ঠেকাল। আমি মাথায় হাত রাখতে ও আপ্লুত হয়ে বলল, ‘ব্লেস মি প্লিজ়!’
তারপর মাথা উঁচু করে সোজা তাকিয়ে বলল, ‘ওয়ান ডে আই মাস্ট বি ফেমাস! দেন উইল কল ইউ! ইওর ফোন নাম্বার প্লিজ়!’
নম্বারটা লিখতে লিখতে কেন জানি না চোখে কোণটা শিরশির করে উঠল, মনে মনে বললাম, কে গো তুমি বিদেশিনী! আজ এই নিস্তব্ধ রাতে, আমার ছবি এঁকে বেঁধে রাখলে সারাজীবনের মতো? ও চলে গেল, সামনের পথ দিয়ে। একটু পরেই রাস্তাট নেমে গেছে নীচের দিকে। ওদিকটায় আলো বিশেষ নেই। ও মিলিয়ে গেল নীলচে অন্ধকারে… অনেকটা স্বপ্নের মতো! আমি ফিরলাম, একটা অজানা বিস্ময় আর ভালোলাগার মিশ্র অনুভূতি…! কোথায় যেন একটা রাতচরা পাখি ডাকছে, কিটিররর্ কিটিররর্! ও সাক্ষী থাকল এই রাতের! তারপর আর দেখিনি শিল্পী রেদেনা ডিস্যুজাকে।
সেদিন দুপুরে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বিকেলে উঠে দেখি রইরই কাণ্ড! বাড়ির বাঁধানো চত্বর সরগরম। একটি ছেলে রায়ান ব্রতর গাড়ি চালায়। সে আর তার ফ্যামিলির সবাই কীসের যেন আয়োজনে ব্যস্ত। ওরা প্রথমদিন থেকেই আমাকে বেশ আপন করে নিয়েছে। গিয়ে দাঁড়ালাম কাছে। ওরা ওদের কথ্য ভাষা তাগালুক বলে। কিন্তু আমাকে ইংরেজি বলতে হচ্ছিল। তাও যতটা সম্ভব সংক্ষিপ্ত। বললাম,
‘কী হচ্ছে?’
‘আজ বার্বিকিউ হবে।’
একটা বিশাল গামলায় ম্যারিনেট করে রাখা রয়েছে বড়ো বড়ো পিস কীসের যেন মাংস। জিজ্ঞেস করায়, জানলাম, ভেড়ার। এদের বার্বিকিউ স্টাইলের খাবার খুব প্রিয়। শুধু যে মাংসই করে তা নয়। বড়ো বড়ো চিংড়ি, অন্যকিছু মাছ, এমনকী আলু, মিষ্টি আলু, বেগুন, তবে সবজি বার্বিকিউয়ের মশলা আলাদা। এরা কাঁচা লঙ্কা রান্নায় ব্যবহার করে না, শুধু স্যালাডে খায়। আসলে ঝাল আর নুন খুব কম খায়। তাই বাঙালির জিভে প্রথমটায় স্বাদ কম লাগে। পরে অবশ্য সয়ে যায়।
এখানে ভাত ঝুরঝুরে নয়। ধবধবে সাদা স্টিকি রাইস।
বার্বিকিউয়ের গন্ধে গেটের বাইরে মার্জারকুলের সমাগম হয়েছে। প্রায় দু-ঘন্টা ধরে পুরো দমে রান্না চলল। তৈরি হলো গ্রিন স্নেল স্যুপ। গাঢ় সবুজের পাড় দেওয়া হালকা সবুজ ঝিনুকের ঝোল। সন্ধে হয়ে এল। আকাশ এখন রঙিন। কিছুক্ষণের জন্য হইচই ছেড়ে নিজের সাথে থাকব। ওপরে চলে এলাম। বিশাল জানলা দিয়ে দেখা যায় অজস্র গাছ, সেসব ভেদ করে একটা চার্চের চূড়া গর্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কয়েকদিন ধরে লক্ষ করছি, এ-সময়টায় একজোড়া পাখি পাশাপাশি দুটো গাছে ডেকে চলে। চেষ্টা করেও দেখতে পাইনি। আজ হঠাৎই ঘন পাতার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে আমার দিকে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর আবার ডাকতে লাগল। নীল রঙের মাঝারি মাপের পাখি। চোখের তলায় কাজলের মতো টানা সাদা সরু দাগ। মাথায় একটা ছোট্টো সাদা পালক উঁচু হয়ে আছে। দু-ভাগ লেজের মাঝখানে একটা সাদা পালক ওর ডাকের তালে তালে তিরতির করে নেচে উঠছে। আমাদের বুলবুলির কথা মনে পড়ল, তবে এটা বুলবুলির থেকে বড়ো। ওই যে ডাক পড়েছে নীচে, যাই! টেস্ট করে আসি বার্বিকিউ। রায়ান সবাইকে ঘুরে ঘুরে জিজ্ঞেস করছে, কেমন লাগছে খেতে! সত্যিই সুন্দর লাগল খেতে।
এখানে আমাদের মতো পাড়ায় পাড়ায় আড্ডা দেওয়ার ক্লাব ইত্যাদির রীতি নেই, লোকজনের দেখা পাওয়া মুশকিল। আমি যখন হাঁটতে বেরোই ইয়োলোবেল স্ট্রিটের একটা বাড়িতে একজনকে বসে থাকতে দেখেছি, মনে হয় উনি এদেশীয় নন। আগেই বলেছি, এক-একদিন দুটো করে রাস্তা বেছে নিই! তাই রোজ এক রাস্তা ধরে হাঁটি না। দু-দিন পরে যখন আবার গেলাম, তখন আর দেখতে পেলাম না। ভাবলাম আমার মতোই হয়তো এসেছিলেন, চলে গেছেন। বাড়িতে ঢোকার মুখে দেখি উলটোদিকের রাস্তা ধরে আসছেন। আমি কী ভেবে একটু দাঁড়িয়ে গেলাম। উনি একটু হেসে গুডনাইট বলে চলে গেলেন। আলাপের কোনো উৎসাহ দেখালেন না। ভাবলাম, না দাঁড়ানোই উচিত ছিল, গায়েপড়া ভাবলেন নাকি? কাছ থেকে দেখে মনে হল, কোরিয়ান হতে পারেন। পাশের বাড়ি থেকে কালো এ্যালসেশিয়নটা ডেকে উঠল গম্ভীর স্বরে। ওই বাড়ির একতলায় এক দম্পতি থাকে। তার হাসব্যান্ড আমেরিকান, স্ত্রী ফিলিপিনো। তাদেরই এই বিশাল কালো এ্যালসেশিয়ান। এই একটা প্রচলন রয়েছে এখানে, প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই পেট ডগ। সে ছোটো হোক বা বড়ো। ব্রতর ল্যাব্রাডর-রিট্রিভার! সেটাও কালো। ওর নাম শ্যাডো। আজ সকাল থেকেই রেডি হওয়ার তাড়া। যেতে হবে কোথায় যেন? ওরা দু-জনেই আমাকে সারপ্রাইজ দিতে চায়, তাই চুপ। ব্রত ফিসফিসিয়ে একবার বলেছে, সমুদ্রে নামার মতো জামাকাপড় নিতে। বুঝলাম ওদের প্ল্যান অনেক বড়ো।
আজ যাওয়া হবে বাতাঙ্গাস। গ্রিন হাইট থেকে বেরোবার সময়ে ওই কোরিয়ান ভদ্রলোককে দেখলাম। এ ক-টাদিন ছিল নিশ্ছিদ্র অবকাশ ছিল । ব্রত আর লিজা অফিস নিয়ে ব্যস্ত। আমিও নিজের মতো রুটিন করে নিয়েছিলাম। মেঘ-রোদের সঙ্গে কাটিয়েছি ভরপুর ছোটোবেলা। প্রায়ই সেই কোরিয়ান ভদ্রলোকের সাথে দেখা হত। একদিন উনি উঠে এলেন। ভাঙা ইংরেজিতে আলাপ জুড়লেন।
‘আপনি কোথা থেকে এসেছেন?’
‘ইন্ডিয়া!’
‘আই সিই! আমি তো গেছি ইন্ডিয়া। গোয়া, বিজ়নেসের কাজে। একবার ক্যালকাটাও গিয়েছিলাম। বিউটিফুল কান্ট্রি!’
আমি হেসে জানালাম। ওটাই অমার শহর। তবে এখন আর ক্যালকাটা নয়, কলকাতা। শুনলাম ওঁর মেয়ে একজন স্থানীয় ছেলেকে বিয়ে করেছে। তাই উনি এখানে থাকেন বছরের অনেকটা সময়। ওর মন এখানে থাকতে চায় না। একজন শিক্ষকের পক্ষে এভাবে বসে বসে কালযাপন সম্ভবও নয়। চলে যাবেন উনি। তবে ওর কেউ নেই এই মেয়ে ছাড়া। ভদ্রলোকের চোখ চিকচিক করে উঠল কথাগুলো বলার সময় । বুঝেছিলাম কতটা কষ্ট থেকে একজন ভিনদেশি মানুষকে এসব বলতে পারা যায়। আজ দেখে একটা হাত তুলে হাসলেন।
আগেরবার যখন এসেছিলাম, গিয়েছিলাম বহোল দীপে। লিখেছি সে গল্প অন্যত্র। কিন্তু আজ এখানে সেই গল্পের উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ছোট্ট করে বলে নিই। বহোল কোরাল দ্বীপ। এখানে ট্যুরিজম একমাত্র জীবিকা বললে ভুল বলা হবে না। অবশ্য কিছু চাষবাস হয়! কাজু বাদামের গাছ অনেক। তবে হোটেলগুলোর সৌন্দর্য দেখলে অভিভূত হতে হয়। সেরকমই একটা হোটেল, ‘দুমালযুয়ান বিচ রিসর্ট’। সমুদ্রের এক্কেবারে ধারে। সেখানেই দেখা পেয়েছিলাম ‘ডো’এর। ওর বোট আমাদের নিয়ে গিয়েছিল মাঝ সমুদ্রে স্কুবা ডাইভিং করতে। ডলফিন দেখেছিলাম ঝাঁকে ঝাঁকে। ডো ছেলেটি অনাথ। সিসিলিয়া নামের একজন তাকে মানুষ করেন। সিসিলিয়ার মেয়ে এঞ্জেলো ছোটো থেকেই ডো এর সাথে মানুষ হয়েছিল। ওর ক্যান্সার ধরা পড়ে কিন্তু ওর মা তাগাইতাই নামে এক জায়গায় রেস্তোরাঁয় কাজ করে সংসার চালান। খরচ চালানো সম্ভব নয়। শেষের দিনগুলো ইচ্ছেমতো কাটাবে বলে ডোয়ের সাথে বহোলে পালিয়ে আসে। এখানেই মারা যায়। ডো সিসিলিয়াকে জানায়নি! সিসিলিয়াকে নিয়মিত টাকা দিয়ে আসে। সিসিলিয়া ভাবে এঞ্জেলোকে ও আটকে রেখেছে, আর রাগের চোটে মারে খুব। ডো তবু যায়। কাজের পর ডো গান বাঁধে, ‘কাম ব্যাক এঞ্জেলো’, রাতে সে গান ট্যুরিস্টদের সামনে গায়! চোখের জল বেচে পয়সা রোজগার করে। চলে এসেছিলাম একবুক কষ্ট নিয়ে। সেই থেকে ডো-কে ভুলতে পারিনি! পরে সে-লেখা পোস্ট করব বন্ধুদের জন্য।
মানটিনলিউপা থেকে বাতাঙ্গাস বেশ অনেকটা দূরে। গাড়ির রাস্তা যত পরিষ্কার, ততটাই দু-পাশের দৃশ্য। সবুজ দুটো হাত যেন আগলে রেখে এগিয়ে দিচ্ছে পথ। এখানে দেখলাম রাস্তাগুলো বেশিরভাগ তিনতলা বা দো-তলা। ফ্লাইওভারে ছড়াছড়ি। কাজেই ফাঁকা জমি প্রচুর পড়ে আছে। আর আছে শপিং মল। ধু-ধু ফাঁকা জায়গায়ও ঝাঁ-চকচকে অত্যাধুনিক বহুতলবাজার। সারা রাত-দিন খোলা। এখানে মলগুলোতে ছোটোদের জন্য কিছু খেলার ব্যবস্থা থাকে। মেঘ-রোদের প্রতি সপ্তাহে বাজার করাটাই একটা সুন্দর আউটিং। বাতাঙ্গাসের কোকোনাট বিচ-রিসর্টে গিয়ে পৌঁছলাম প্রায় দুপুর তিনটে। সমুদ্র বালি ভিজিয়ে এখন ফিরে গেছে। কিছু কিছু জায়গায় রেখে গেছে ডুব ডুব জল। আবার আসবে সেই কাল সকালে। এখন কাঁকড়াদের ভিড়, কতরকম তাদের রং, লাল তো আছেই, তার সাথে সাদা, কালো, ধূসর! নেমে গেলাম ভিজে বালিতে। ছোটো বড়ো কাঁকড়াগুলো আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলা শুরু করল, পা ফেললেই তারা ঢুকে পড়ে গর্তে । সরিয়ে নিলেই ‘টুকি’ বলে উঁকি মারে। খানিকটা বালি দিয়ে হেঁটে গেলে একটা বাঁশের ভেলা কে যেন বেঁধে রেখে গেছে। সেখানে গিয়ে বসলাম। সূর্যদেব পাটে বসেছেন, আকাশ ঠিক আমার দেশের মতোই রঙিন। আকাশ বা সূর্যের কী-বা আসে যায়, কে কোথায় আছে! তারা রোজ মুঠো মুঠো রং ছড়িয়ে সুন্দর করে তোলে প্রকৃতি…!
অন্ধকার নেমে আসছে দ্রুত। দূরে বিন্দু বিন্দু আলো! মাছের নৌকা। বেশি ট্যুরিস্ট আসে না এখানে। কিন্তু কী বিশাল আয়োজন এদের। দুটো স্যুইমিং পুল এমনভাবে তৈরি, একটু দূরে দাঁড়ালে মনে হয় যেন সমুদ্রটাই কাছে চলে এসেছে। একটা জিনিস খুব ভালো লাগল, এই বিচ আর সাঁতার-পুষ্করিণী দুটোই খুব পরিচ্ছন্ন। দূরে একটি ছোট্ট মেয়ে তার মায়ের সঙ্গে কী যেন কুড়োচ্ছে! আবার ফেলে দিচ্ছে সমুদ্রের রেখে যাওয়া জমা জলে। কিছু কিছু ছুড়ে দিচ্ছে সমুদ্রে। একটু এগিয়ে বললাম, ‘অন্ধকারে কী কুড়োচ্ছ?’
‘ঝিনুক আর শাঁখ!’
‘তবে ফেলে দিচ্ছ কেন?’
‘ওগুলো জ্যান্ত! জল বাড়লে চলে আসে, কিন্তু আর ফিরে যেতে পারে না! ওরা মরে যাবে যে!’
একটা অদ্ভুত শিহরণ শিরদাঁড়ায়! এরা সমুদ্রকে ভালোবাসে, সত্যিই ভালোবাসে। মৃত ঝিনুকের খোসা কুড়িয়ে ওরা চলে গেল। কাছের গ্রামেই থাকে। যাবার সময় আমাকে একটা সুন্দর শাঁখ আর ঝিনুকের খোসা দিয়ে গেল। বললাম, ‘মনে রাখব। ‘এ-জীবনে এরকম অনেক বহুমূল্য উপহার জমা হল। যার আর্থিক মূল্য কানাকড়িও নয়। বড়ো ভালো লাগে, মন আর চোখ ভরে ওঠে কৃতজ্ঞতায়। যেতে হবে, ডাক পড়েছে… আমার ছোট্ট দুই রাজকুমার এসেছে ডাকতে! সমুদ্রকে বললাম, আবার আসব কাল। লিজা ঝোঁক ধরেছে, রাতের খাবার আরেক জায়গায়!
প্রায় জঙ্গলের রাস্তায় চলেছি, অন্ধকার গাড়ির ভেতরেও। শুধু মুঠোফোন জ্বলছে, আর বলে দিচ্ছে রাস্তা। এখানে কোথায় রেস্তোরাঁ থাকতে পারে ভাবছি, এক জায়গায় আলোর ঝিকিমিকি চোখে পড়ল। ‘দ্য টেস্ট’। রেস্তোরাঁ বলছি, কিন্তু আসলে ঘরোয়া, ফ্যামেলির সবাই চালায়। হাসিমুখে অভ্যর্থনা করাই দস্তুর এসব জায়গায়! কিন্তু এদের মধ্যে ওই প্রফেশনাল হাসি নয়, বেশ আন্তরিক হাসিই দেখলাম। খেলাম এদের স্পেশাল ডিস, লোমি নুডলস। স্যুপের মধ্যে নুডলস, অসাধারণ তার স্বাদ। স্ট্রবেরি ড্রিঙ্কস উইথ এলোভেরা, ফ্রুট স্যালাড। এখানে ফ্রুট আইটেম খুব কমন। পুচকেদুটো লাফালাফি করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। গাড়িতে ওরা ঘুমিয়ে পড়ল। আমি সজাগ আর পূর্ণদৃষ্টিতে জঙ্গলের নিস্তব্ধ অন্ধকারে ছড়িয়ে দিচ্ছিলাম নিজেকে। জঙ্গলের টান আমার শিরায় শিরায়, ব্রতর রক্তেও সেটা সঞ্চারিত হয়েছে… ও গাড়ি চালাচ্ছে চুপচাপ। হেডলাইটের আলোয় যেটুকু রাস্তা দেখা যায়, তাতে মনে হচ্ছে জঙ্গল সরে গিয়ে পথ করে দিচ্ছে আমাদের। গাছেদের ঘুম ভেঙে যাচ্ছে তীব্র আলোয়…
পরেরদিন যখন আমার ঘুম ভাঙল, বেশ আলো ফুটে গেছে। সমুদ্রও চাঁদের টানে তীরমুখো। আজ ওর সাথে প্রাণের খেলা। সেই বাঁশের ভেলায় বসলাম, সমুদ্রে পা ডুবিয়ে। ছলছল করে জল বাড়ছে। জল বাড়লে বেশ কিছু ছোট্ট ছোট্ট মাছ দেখছি পাড়ের কাছে চলে আসছে। ভেলায় লেগে থাকা শ্যাওলা আর শাঁখ খাচ্ছে ওরা। এবার ভেলার ওপর উঠে এসেছে জল। আমিও উঠলাম। এখানে ঢেউ বাড়লেও, বালি আর কোরাল বেড থাকায় উত্তাল নয়। বেশ আদুরে উচ্ছ্বলতা! তীরে সারি সারি গাছ, দুটো পর পর ঝাঁকড়া সাদা ফুলের গাছ। দেখতে অনেকটা গন্ধরাজের মতো, কিন্তু গন্ধরাজ নয়, অনেক বড়ো এগুলো। গাছ ভরে রয়েছে। বসলাম তার তলায়। কিছুক্ষণ পরে কে যেন বসল এসে। দেখলাম, একটি ছেলে গহনা নিয়ে এসেছে, ঝিনুক, শাঁখ, মুক্তো, আরও নানারকম কীসব দিয়ে তৈরি। ওর নাম, রিপ। বলল, বাড়িতে বুড়ো বাবার সাথে থাকে ও। এই গহনাই ওর রোজগার। চলে যায় বাবা-ছেলের একরকম। মাঝে মাঝে নারকেল আর মাছ বিক্রি করে। হাসতে হাসতে বলল, একবেলা তো খাওয়া, সকালটা তো বিক্রিবাটা করতেই কেটে যায়। দু-বার আইস টি খেলেই চলে। বিকেলে ফিরে খেয়ে নিলে আর লাগে না কিছু। সত্যিই, বেঁচে থাকতে গেলে খাদ্য জরুরি, কিন্তু হাসিটা আরও জরুরি।
ছোট্ট ছোট্ট হাত-পায়ে সাঁতার কাটছিল রোদ আর মেঘ। এবার লিজা নেমে ডলফিনের মতো ডিগবাজি খেতে লাগল জলে। কতরকম টেকনিক জানে ও। ওদের মাতাপুত্রের খেলা দেখতে দেখতে কেটে গেল অনেকটা সময়। ইতিমধ্যে অনেক ট্যুরিস্ট এসে গেছে। সবাই একটু আলাপের মুডে! একজন রিপের দিকে ইশারা করে ফিসফিস করে বললেন, ‘কিচ্ছু কিনবেন না ম্যাম, ওর সব বাজে কথা। ডবল দাম চাইছে বিদেশি বলে।’
ওহো! এখানে তো আমি বিদেশিনী। হাসলাম নিজের মনে। এরা একসাথে অনেকে এসেছেন, বাচ্চরাও আছে। সবাই হইহই করে সমুদ্রে নামল। বেশ ভেজা যায় নির্ভয়ে। সমুদ্র থেকে উঠে স্নানের আয়োজনও ভারি সুন্দর।
আমি দেখতেই এসেছি। কোনো কোণ বাকি থেকে গেলে নিদারুণ ক্ষতি। আমার একটা দোষ আছে, ট্যুরিস্টদের সাথে আলাপচারিতা বেশিক্ষণ ভালো লাগে না। কেমন যেন প্রাণ পাই না। স্থানীয় মানুষ অনেক আকর্ষণীয়। আরও একটা অভ্যাস, যেখানেই যাই, একা ঘুরতে চাই অন্তত কিছুক্ষণ। যাচ্ছেতাই অভ্যাস। কী আর করা যাবে! উঠে পড়লাম।
ঘুরতে ঘুরতে দেখি একটা পায়েচলা রাস্তা চলে গেছে কোথায় যেন। চললাম ওটা ধরে। রিসর্টের সীমার পাশ দিয়ে চলে গেছে সেটা। সামনে একটা পাহাড়, খুব বেশি উঁচু না। হয়তো অনেকটাই দূরে, কেমন মেঘের মতো নীলচে রং। এখানে এমন পাহাড় সর্বত্র। আগ্নেয়দ্বীপ তো! শহর থেকে কিছুটা গেলেই গ্রাম্য পরিবেশ। কিন্তু আধুনিকতার অভাব নেই। প্রতিটি গ্রামের বাড়ি অজস্র ফুল দিয়ে সাজানো। এসব দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম জেলেদের লোকালয়ে। আমরা জেলেবস্তি বলতে যা বুঝি, এটা তেমন নয়। এদের চালাঘর ঠিকই, কিন্তু ঘিঞ্জি নয়। কোনো একজনের উপার্জনের ওপর এরা নির্ভর করে থাকে না। মেয়েরা দেখলাম নানারকম কাজ করছে। মুরগি হাঁস পোষা, গয়না তৈরি, আর কতরকম খাবারের প্যাকেট তৈরি করছে। অনেকটা পাঁপড়ের মতো দেখতে এক ধরনের খাবার। বলল, চিংড়ি থেকে তৈরি, চালের চিপস, চালবাটার পিঠে, অনেকটা আমাদের পিঠের মতোই, কিন্তু ভেতরে চকোলেটের পুর। কতরকম যে মাছ, ছোটো ছেলে-মেয়েরাও বাবার সঙ্গে বেরিয়েছে বিক্রি করতে, ফিরে এসে স্কুলে যাবে। এইরে! বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেছে। ওরা খুঁজছে না তো? একটু তাড়াতাড়ি পা চালাই।
ওখান থেকে বেরোতে বেলা হল। এবার ফেরা হবে অন্য পথে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ডাব খাওয়া হল। সে স্বাদ ভোলার নয়। এরা বলে ‘বুকো’। এখানে ডাবের অনেকরকম খাবার পাওয়া যায়। ডাবের শাঁস দিয়ে আইসক্রিম, রাইসকেক উইথ বুকো, এইসব। ডাবের জলও ভীষণ সুন্দর স্বাদ। এবার গাড়ি চলেছে শহরের মধ্যে দিয়ে। এই আগ্নেয়দ্বীপ ভূমিকম্পপ্রবণ, তবুও এত বহুতল কীকরে! অবাক হবার মতো। কুড়িতলা তো সাধারণ ব্যাপার। তবে বিচ্ছিন্ন কিছু অঞ্চলে। বেশিরভাগ জায়গায় একতলা, দোতলা বাড়ি। এদের ছাদে ওঠার সুখ নেই। সব নানারকম স্টিলের পাত দেওয়া ঢালু ছাদ। এবার ওপরে উঠছি, আস্তে আস্তে আবহাওয়া পালটাচ্ছে। পালটাচ্ছে গাছের আকৃতি প্রকৃতি। পাহাড়ি এলাকার মতো ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হল। বৃষ্টি মাঝে মাঝে থামছে অবশ্য, ঘন কুয়াশার মধ্যে দিয়ে চলেছি, গাড়ির গতি মন্থর। উঠে এসেছি বেশ কিছুটা উঁচুতে। ব্রত বলল, এটা তাগাইতাই। এখানেই আছে সক্রিয় আগ্নেয়গিরি ‘তাল’। মাঝে মাঝেই ধোঁয়া বেরোয়। নামটা শুনে অবধি, চেনা চেনা লাগছিল। এখন মনে পড়ল, ডো বলেছিল, এখানেই থাকে এঞ্জেলোর মা সিসিলিয়া। ডোয়ের সিলি। কে জানে কোথায় থাকে! ‘তাল’ মানে ‘হ্রদ’, সে তো সবার জানা। এই ভলক্যানোর বিশাল জ্বালামুখের চারপাশে তৈরি হয়েছে সুবিশাল হ্রদ। হয়তো তাই এমন নাম। এই হ্রদকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু হোটেল, রেস্তোরাঁ, এমনকী রিসর্টও। এর মধ্যেই নিশ্চয় কোনোটা সিসিলিয়ার। মনের মধ্যে একটা অদম্য আশা হল, যদি খুঁজে পাই!
আমরা গেলাম একটা সাজানো-গোছানো রিসর্টে। নেচার্স রিসর্ট। ইতস্তত ঘুরছি, দেখছি। এখানে ভেষজের চাষ হয়। কতরকম যে জড়িবুটি আর হরেক রকম তেল। কোনোটা রিফ্রেশিং, কোনোটা হিলার, আবার কোনো কোনো নির্যাস খিদে বাড়ায়, ব্যথা কমায়। ট্রিটমেন্টও হয় এখানে। যাওয়ামাত্রই একজন সুবেশী তরুণী আমাকে সুদৃশ্য পর্দাঘেরা শেডের তলায় ইজ়ি চেয়ারে প্রায় শুইয়ে দিল। একটা বড়ো গামলার মতো পাত্রে জলের (কিম্বা অন্য কিছুর) ওপরে নানারকম পাতা ভাসছে দেখলাম। সেখানে আমার পদযুগল ধাঁ করে ডুবিয়ে দিয়ে কী যেন একটা ধরিয়ে দিল হাতে। দেখি বেশ বড়োসড়ো গ্লাসে হালকা সবুজাভ পানীয়। গোলাপের পাপড়ি দেওয়া। আমি চুমুক দিলাম। অসাধারণ মিষ্টি গন্ধে বুক পর্যন্ত জুড়িয়ে গেল। কিন্তু স্বাদ একটু কষা। কেউ কি বলতে পারে? অমৃত ভেষজগুণ সমৃদ্ধ হলেও খেতে ভালো ছিল? হয়তো এমনই… হা হা হা…!
আমার পায়ের পাতা থেকে হাঁটু পর্যন্ত চলল দলাইমলাই দুটো হাত আর মাথাও হল। বেশ তরতাজা অনুভূতি নিয়ে চারিদিকটা ঘুরে দেখছি। অনেক বড়ো জায়গা এটাও। আজ এখানেই খাওয়াদাওয়া। তাল আগুনপাহাড়ের পাশে একটা টেবিল বুক করা আছে। সেখানে বসে আগ্নেয়গিরির দিকে তাকিয়ে রইলাম। সক্রিয় ওটা! এদের ভয় করে না! মৃত্যুর সঙ্গে বাস করা… শুনলাম যখন সংকেত পায়, সব ফেলে সরে যেতে হয়। একজন হেসে বললেন, ‘এই তাল তো অন্ন দিচ্ছে কিছু মানুষকে ম্যাম! ভয় পেলে চলবে কেন? বিপদ কোথায় নেই?’ ভেবে দেখতে গেলে, কথাটা ঠিকই। ব্রত দু-হাতে এত্তো বড়ো বড়ো দুটো ডাব নিয়ে আসছে, বলল, এটা নাকি বুকো ককটেল।
পেল্লায় একটা ডাবের ভেতর কী কী যেন দেওয়া, মুখের কাছে সবুজ তরতাজা দুটো পাতা বেরিয়ে আছে। দেখে পুদিনা মনে হলেও গন্ধ অন্য। স্ট্র আর চামচ দুটোই আছে। সময় ব্যয় না করে ঠোঁট ছোঁয়ালাম। ডাবের জলের সাথে আইসক্রিমের স্বাদ। বেশ অন্যরকম। জল শেষ হতেই পেট ভরে গেল। এরপর আবার এক এক স্তরে এক এক রকম আইসক্রিম। খাচ্ছি আর ভাবছি, ওই আপাত নিরীহ জ্বালামুখের গর্ভে কী অসীম শক্তি নিয়ে ফুঁসছে ম্যাগমা। মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে ভয়কে গুরুত্ব দেয় না। দিলে বেঁচে থাকা যায় না। এর উদাহরণ ছড়িয়ে আছে বিশ্বময়। এখানেই মৃত্যুকে হারিয়ে দেয় জীবন। বেঁচে থাকাটাই প্রাণীর ধর্ম। নানাভাবে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে যুগ যুগ ধরে, দৈহিক, মানসিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে। তাই জীবনকে সম্মান জানাতেই হয়।
সি-ফুড দিয়ে মুখোরোচক একটা লাঞ্চ সেরে ফেরার তাড়া। দেখলাম একজন বয়স্কা মহিলা টেবিল পরিষ্কার করছেন। ঈষৎ ঝুঁকে পড়েছেন। এদের তাগালুক ভাষা জানি না। ইংরেজিতে বললাম, ‘এক্সকিউজ মি! আপনি সিসিলিয়া নামে কাউকে জানেন?’ অদ্ভূত চোখে তাকালেন। স্পষ্ট ইংরেজিতে বললেন, ‘আপনি ওকে চেনেন?’
ঘাড় নাড়ি। বললেন, ‘ও আর নেই। প্রায় একবছর হল মারা গেছে। এখানেই কাজ করত। বড়ো দুঃখী মানুষ ছিল। ওর মেয়েটা, ওই এঞ্জেলো, মারা যাওয়ার পর!’
অবাক হলাম। বললাম, সিসিলিয়া জানত এঞ্জেলো নেই? ডো যে বলেছিল…!
ফিরে তাকালেন। অবাক হয়ে বললেন, ‘কাম, সিট। তুমি এদেশের মানুষ নও। ডো-কে চিনলে কীকরে?’
বললাম সব। ব্রতর পরিচয়ও দিতে হল। মহিলা শুনে ঘাড় নাড়লেন, মুখটা কেমন বিষাদে ভরে গেল। বললেন, ‘দ্যাট সিলি বয়! ও ভাবত সিসিলিয়া কিছু জানে না! আসলে সবই জানত। কিন্তু বোঝায়নি। যাহোক তবু তো আসত ছেলেটা! ওকেও তো সন্তানের মতো মানুষ করেছিল বেচারি!’
স্তব্ধ আমি, ঈশ্বরকে দেখিনি। তবু তাঁর ছায়া দেখতে পেলাম ডো আর সিসিলিয়ার মধ্যে। হৃদয় পূর্ণ হলে অনেকসময় বেশ ভারী হয়ে যায়। হয়তো ছায়া পড়েছিল মুখে। মহিলা আমার কাঁধে হাত রেখে হাসলেন। আন্তরিক হাসি, ‘কী আশ্চর্য দেখো! কতদূর থেকে এসে আজ সিসিলিয়ার জন্য একফোঁটা টিয়ার্স!’
জীবনে চলতে চলতে হঠাৎ কোনো চরিত্রের সাথে দেখা হয়ে যায়, যারা পাঠ শিখিয়ে নেয়, তারপর হারিয়ে যায়। এ বড়ো রহস্যময় জার্নি!
রোদ আর মেঘ ঘুমিয়ে পড়েছিল গাড়িতে। ওদের গায়ের গন্ধ বাঁচার রসদ জোগায়। আর কয়েকটা দিন আছি ফিলিপিন্সে। কী দ্রুত কাটছে সময়। রোজ সন্ধ্যায় একটা পাখি ডাকে, আগেই বলেছি। সন্ধ্যার আরেকটা আকর্ষণ চার্চের চূড়ার পিছনে সূর্যাস্ত। ঘন্টার শব্দে বিদায় দেওয়া ক্লান্ত সূর্যকে। এখানে অর্থনৈতিক ক্লাসিফিকেশন ততটা নেই। বিশাল বাড়ির পাশেই ছোট্ট বাড়ি, পাড়া কালচার না থাকলেও সবাই বেশ সম্মানীয় ব্যবহার রেখে চলে।
সেই কোরিয়ান ভদ্রলোককে বলেছিলাম, আমার যাওয়ার দিন এগিয়ে আসছে। উনি একদিন আইস টি খাওয়ার নেমন্তন্ন করলেন। বন্ধুত্বের কোনো ভাষা, কোনো কারণ, কোনো নিয়মের প্রয়োজন হয় না, শুধু অনুভব করতে পারলেই বন্ধু হওয়া যায়।
ম্যানিলা সিটি থেকে খানিকটা দূরত্বে ইসকন মন্দির গেলাম। পথে পড়ল মায়ন আগ্নেয়গিরি। এটা আটহাজার ফিট উঁচু। শুনলাম গত বছরেই এর মাথায় লাভার আলো দেখা গেছিল। ফিলিপিন্স গভর্নমেন্ট সবসময় প্রস্তুত, যুদ্ধকালীন তৎপরতায় মানুকে নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে যেতে।
যাওয়ার আগে আরেকটা জায়গায় যাব। একেবারে নির্জন একটা ইকোরিসর্ট। এখানে সমস্ত ফার্মহাউসগুলোতেই থাকার জন্য কিছু কটেজ রাখা থাকে। সেখানে রান্নার ব্যবস্থাও থাকে। মজা করে উইকএন্ড কাটানোর সুযোগ পাওয়া যায়। এখান থেকেও মায়ন আগ্নেয়গিরি দেখা যায়। মাঝে মাঝে ছাই, ধোঁয়াও বেরোতে দেখা যায়। এরা জানেন বোধ হয়, ঠিক কখন বিপদ হতে পারে। সদাসতর্কতার মধ্যেও কত স্বচ্ছন্দে থাকে এখানকার মানুষ।
আজ এসেছি ক্যালিরায়া ইকো ভিলা। ওই যে বললাম, ফার্মহাউস। বিশাল জায়গা জুড়ে এই ইকো ভিলেজ। ফুল, ফল থেকে মুরগি, শুয়োর সব কিছুই চাষ হয়। মাছও। মাছ ধরার সরঞ্জাম পাওয়া যায়। রাত্রি এখানে প্রকৃতই বন্য। আলো বেশ কম। অন্ধকারকে আপন করার এরচেয়ে ভালো জায়গা একমাত্র ডুয়ার্সে পেয়েছি। এ-জঙ্গল ডুয়ার্স নয়। বন্যপ্রাণী নেই, সবই নিরাপদ, পালিত পশু। শুধু অজস্র গাছপালার সঙ্গেই আলাপ করা যায় নিভৃতে। এখানে একজন গার্ডের দেখা পেলাম। বললাম, ‘এই এতবড়ো রিসর্টে একা গার্ড?’
হাসল ছেলেটি। বলল, এখানের আসল গার্ড আমার বাচ্চারা। একদল সারমেয় তার বাহিনী। কার সাধ্য অনধিকার প্রবেশ করে? দু-পাশে দু-টি গেট হাট করে খোলা। এই রিসর্টের মধ্যে দিয়ে পথটি দু-টি রাজপথকে যুক্ত করেছে। পথচারীরা দিব্যি যাওয়া-আসা করেন। আর লক্ষ রাখেন এই বিশাল কৃষিক্ষেত্রের। স্বার্থ খুব একটা থাবা বসাতে পারেনি এখানে। ফেরার পথে ময়ানকে প্রণাম জানালাম। কতশত মানুষের জীবিকার দায়িত্ব তার মাথায়!
অদ্যই শেষ রজনী। ফিরব আমার দেশে। মনটা কানায় কানায় পূর্ণ। আমার অস্তিত্বের টুকরো রেখে গেলাম, সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। ব্রতর বাড়িতে একটি মেয়ে থাকে ‘মেইলা’, বড়ো ভালোবেসে ফেলেছিল আমায়। আজ সন্ধ্যায় নেমন্তন্ন আমার ভিনদেশী বন্ধুর। চলে যাব, কেমন করে যেন তাকালেন। বললেন, ‘মনে থাকবে তোমায়। হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর দাও।’
হ্যান্ডশেকের কায়দায় হাত ধরে বললেন, ‘নাছোড়বান্দা এক জীবাণু আমার রক্তে রাজত্ব করছে। বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। ডাক যখন সত্যিই আসবে, জানাব জ্ঞান হারাবার আগে। একবার কথা বোলো তখন। গুড বাই!’
আমি ফোন নাম্বার দিয়ে এসেছি তাকে। ভারাক্রান্ত মন। শিল্পী রেদেনা ডিস্যুজাকে মনে পড়ল। সেই জায়গায় গেলাম একবার। ফোন নম্বর রাখিনি ইচ্ছে করেই। জমা থাক ভেতরে।
তোমরা ভালো থেকো আগুন পাহাড়ের বন্ধুরা।
হয়তো আবার দেখা হবে! হয়তো-বা হবে না!
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
মন্তব্য করুন